ময়নূর রহমান বাবুল – এর জন্ম ইংরেজি ১৯৫৭ সালের ৩০শে আগস্ট তথা ১৩ই ভাদ্র ১৩৬৪ বঙ্গাব্দে। তাঁর পৈত্রিক নিবাস, সিলেট জেলার বালাগঞ্জ উপজেলাধীন বর্তমান ওসমানী নগর থানার খাপন গ্রামে।
বাবুলের শিক্ষা জীবন শুরু হয় স্থানীয় কুরুয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে। তারপর কুরুয়া উচ্চবিদ্যালয়, তাজপুর মঙ্গলচণ্ডী নিশিকান্ত উচ্চবিদ্যালয় এবং জমির আহমদ উচ্চবিদ্যালয়ে মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। সিলেট সরকারী এম সি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক এবং স্নাতক করেন।
সিলেট সরকারী এম সি কলেজে অধ্যয়ন কালিন ছাত্ররাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন ময়নূর রহমান বাবুল। তিনি ১৯৭৯-৮০ শিক্ষাবর্ষে সিলেট সরকারী এম সি কলেজ ছাত্রসংসদের জি এস নির্বাচিত হন বিপুল ভোটাধিক্যে। চলে আসেন সিলেটের ছাত্র রাজনীতির সামনের সারিতে। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের আদর্শে দীক্ষিত হয়ে সে সময়ে সিলেট জেলা ছাত্রলীগের বিভিন্ন দায়িত্বশীল পদে থেকে কাজ করেন।
শোষিত বঞ্চিত মেহনতি মানুষের দাবী আদায় আর সংগ্রামের লক্ষ্যে বাবুল নিজেকে নিয়োজিত করেন। খেটেখাওয়া মানুষের কাতারে চলে আসেন বাবুল। যোগ দেন বাম রাজনীতিতে। আশির দশকে সিলেটের কৃষক ক্ষেত মজুরদের আন্দোলনে সম্পৃক্ত করেন নিজেকে।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির একজন সক্রিয় সদস্য হিসাবে বাবুল নিজের এলাকায় সংগঠিত করেন বিভিন্ন আন্দোলন এবং এসব আন্দোলনে সামনের কাতারে থেকে নেতৃত্ব দেন। সিপিবি বালাগঞ্জ উপজেলা কমিটির সংগ্রামী সম্পাদক এবং সিলেট জেলা কমিটি সিপিবি’র সদস্য হিসাবে তিনি কাজ করেন অত্যন্ত দৃঢ়তা ও গৌরবের সাথে।
বালাগঞ্জ সহ সিলেটের বিভিন্ন এলাকায় খেতমজুর কৃষকদের বিভিন্ন আন্দোলন ছাড়াও স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে বাবুল সক্রিয় কাজ করেন। এজন্য বিভিন্ন সময় গ্রেপ্তারী পরওয়ানা মাথায় নিয়ে তাঁকে ঘুরতে হয়। কয়েকবার তিনি গ্রেপ্তার এড়াতে পারলেও ১৯৮৮ সালে অবশেষে গ্রেপ্তার হয়ে দীর্ঘদিন কারাবাসে থাকেন।
একই সাথে বাবুল স্থানীয় যুব সমাজের কাছে একজন দক্ষ সংগঠক ও সংস্কৃতিকর্মী হিসাবে খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। বিভিন্ন সামাজিক, সাহিত্য,সাংস্কৃতিক, শিক্ষা এবং সমাজকল্যাণ মূলক সংগঠনের সাথে থেকে কাজ করেন। নিজের এলাকায় গড়ে তোলেনঃ কুরুয়া হেমন্তি সাংস্কৃতিক সংঘ, সংক্ষেপে ‘কুহেসাস’ নামের সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন। যা সেসময় নিজ এলাকা, সিলেট জেলা পেরিয়ে দেশব্যাপী পরিচিত ছিল।
এছাড়াও বাবুল বাংলাদেশ উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর স্থানীয় উপজেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক, সিলেট জেলা কমিটির সদস্য এবং জাতীয় পরিষদ সদস্য ছিলেন দীর্ঘদিন। তিনি বাংলাদেশ লেখক শিবির সিলেট জেলা কমিটির সাথেও সম্পৃক্ত ছিলেন। সিলেটের সুপরিচিত সংগঠন, সমস্বর লেখক ও শিল্পী সংস্থা সহ অনেকগুলো সগঠনের বিভিন্ন দায়িত্বে থেকে কাজ করেন। সিলেট রেডিও’র বিভিন্ন অনুষ্ঠানের সাথেও কাজ করেছেন তিনি।
কলেজ জীবন থেকেই বাবুল সম্পৃক্ত হন সাংবাদিকতার সাথেও। স্থানীয় সিলেট সংবাদ পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। সাপ্তাহিক দেশবার্তা পত্রিকার নিজস্ব প্রতিনিধি, দৈনিক বাংলার বাণী’র বিশেষ প্রতিনিধি ইত্যাদি ছাড়াও সিলেটের যুগভেরি, সিলেট সমাচার সহ স্থানীয় ও জাতীয় পত্রপত্রিকায় নিয়মিত অনিয়মিত সংবাদ প্রেরক হিসাবে কাজ করেছেন। বালাগঞ্জ প্রেসক্লাবের তিনি প্রতিষ্ঠাতা সাংস্কৃতিক সম্পাদক ছিলেন।
কৈশোর থেকেই লেখালেখির সাথে জড়িত। কবিতা, ছোট গল্প দিয়েই সাহিত্যের জগতের পথে হাঁটি হাঁটি পা পা করে চলেছেন। স্থানীয় ও জাতীয় পত্রপত্রিকা, ম্যাগাজিন, সাময়িকীতে প্রচুর কবিতা ও গল্প প্রকাশিত হয়েছে এবং হচ্ছে। নিজেও সম্পাদনা ও প্রকাশ করেছেন অনেকগুলো সময়িকী। তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত সংকলনের মধ্যে মৃদুগুঞ্জন, প্রাণপলি, ঝংকার সবিশেষ উল্লেখ যোগ্য।
যুক্তরাজ্যে ১৯৯৩ সাল থেকে প্রগতিশীল জার্নাল সমাজ চেতনা’র সাথে জড়িত হয়ে এর প্রকাশনা ও প্রচারণার কাজে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন।
লেখার হাত তাঁর চলমান। কিন্তু থেমে থেমে। চলার ফাঁকে ফাঁকে মাঝে মধ্যে একটু আধটু জিরিয়ে নিয়েছেন ঠিকই। তবু লিখছেন।
১৯৯১ সালে প্রথম প্রকাশিত হয় ময়নূর রহমান বাবুলের গল্পের বই- প্রত্যাশার প্রতিধ্বনি। তারপর ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত হয় প্রথম কবিতার বই- স্বদেশ আমার মা আমার। অতঃপর দ্বিতীয় কবিতার বই- ভালোবাসায় আগুন জলে প্রকাশিত হয় ২০১২ সালে। এই একই বছর প্রকাশিত হয় অপর কাব্যগ্রন্থ, ছিনিয়ে নেব।
স্মৃতিচারণ মূলক প্রবন্ধের বই – চোখের দেখা প্রাণের কথা প্রকাশিত হয় মে, ২০১৩, চতুর্থ কবিতার বই – বিন্দু আমার বৃত্ত প্রকাশ হয় জুন, ২০১৩ এবং প্রথম প্রকাশিত ছড়ার বই – ছড়া দুইছড়া প্রকাশ হয় জুন,২০১৩ সালে। এ বছর পলল নামে একটি সংগঠনের উদ্যোগে লন্ডনে এক আড়ম্বরপূর্ণ প্রকাশনা ও মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে প্রধান অথিতি হিসাবে উপস্থিত থাকেন, বিশিষ্ট উদ্ভিদ বিজ্ঞানী ও লেখক পরিবেশবিদ প্রফেসর দ্বিজেন শর্মা।
বাবুলের দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ নীল জ্বলে নীল বিষ প্রকাশিত হয়েছে ফেব্রুয়ারি ২০১৫ সালে এবং তৃতীয় গল্পগ্রন্থ নিগূঢ় পরম্পরা প্রকাশিত হয়েছে মার্চ ২০১৫ সালে। এ দুটি গল্পগ্রন্থের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসাবে ২০১৫ সালের আগস্ট মাসে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ প্রফেসর অমর্ত্য সেন উপস্থিত ছিলেন। বই দুটোর উপর আলোচনা করেন যথাক্রমে, কবি লেখক ডা মাসুদ আহমদ এবং লেখক ও উপন্যাসিক সালেহা চৌধুরী।
বাবুলের পঞ্চম কবিতার বই – হ্যাঁ জয়যুক্ত হলো প্রকাশিত হয় বইমেলা ফেব্রুয়ারি ২০১৬ সালে । তারপর ষষ্ট কবিতা গ্রন্থ দুঃখ তবুও দাও প্রকাশিত হয় ফেব্রুয়ারি বইমেলা ২০১৭ তে। এ বছরের মাঝামাঝি লন্ডনে অনুষ্ঠিত এ বইয়ের আড়ম্বরপূর্ণ প্রকাশনা অনুষ্ঠানে প্রধান অথিতি হয়ে আসেন আমেরিকা প্রবাসী প্রখ্যাত গল্পকার ও লেখক জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত এবং বিশেষ অথিতি ছিলেন নারীবাদী লেখক ও প্রখ্যাত পুষ্টি বিজ্ঞানী পূরবী বসু।
২০১৮ সালে বংলাএকাডেমী বইমেলায় প্রকাশিত হয় বাবুলের দ্বিতীয় ছড়া গ্রন্থ – চড়া দামে ছড়া ।
মুক্তিযুদ্ধের তথ্য ও উপাত্তের চারণ সংগ্রাহক, লেখক গবেষক তাজুল মোহাম্মদের সাথে যৌথ সম্পাদনায় ময়নূর রহমান বাবুলের এপর্যন্ত তিনটি বই প্রকাশিত হয়েছে, একাত্তরে সিলেটঃ স্মৃতিকথা-১৯৯৪, একাত্তরের স্মৃতিগুচ্ছ– ১৯৯৮, প্রফেসর মোহাম্মদ আবদুল আজিজ সন্মাননা গ্রন্থ – ২০১৩।
সংহতি সাহিত্য পরিষদের উদ্যোগে প্রকাশিত সংহতি নির্বাচিত কাব্য সংকলন-৩ প্রকাশিত হয় শামিম শাহানের সাথে যৌথ সম্পাদনায় ২০১৭ সালে লন্ডনে।
প্রখ্যাত লেখক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক তাজুল মোহাম্মদকে নিয়ে ২০১৯ সালে প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধের ধুলিপথের চারণ তাজুল মোহাম্মদ সম্মাননা-গ্রন্থ তারই উদ্যোগ ও সহযোগিতায় প্রকাশিত হয়। এ গ্রন্থখানির তিনি অন্যতম সম্পাদকও।
গল্প, কবিতা ছড়া আর প্রবন্ধ মিলিয়ে এ পর্যন্ত বারোটি বই আর যৌথ সম্পাদনায় সম্পাদিত পাঁচটি বই পাঠকদেরকে উপহার দিয়েছেন ময়নূর রহমান বাবুল।
বাবুল ব্যাক্তিগত জীবনে একজন ব্যাবসায়ী। ১৯৯২ সাল থেকে যুক্তরাজ্যে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। তাঁর সহধর্মিণী শিরীন আকতার। দুই মেয়ে, জাকিয়া সুলতানা শিবা আর ইরিনা সুলতানা জাহিন।
ময়নূর রহমান বাবুল সুসাস্থ এবং দীর্ঘ জীবন নিয়ে সমাজ প্রগতি আর সমাজ উন্নয়নের লক্ষ্যে আরও তেজদিপ্ত লেখনী দ্বারা সমাজকে উপকৃত করবেন এটাই আমরা প্রত্যাশা করি।
তথ্য সংগ্রহে যারা সহযোগিতা করেছেন : আনোয়ারুল ইসলাম অভি, গোলাম আকবর মুক্তা, সাগর রহমান, শামীম শাহান