কি ঘর বানাইমু আমি : হাসন রাজা । ( ১৮৫৪-১৯২২ )
বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিলেত অবস্থান কালে তার বক্তৃতামালায় অত্যন্ত বিনয়ের সাথে, যাদের সাহিত্য ও ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হয়েছেন বলে স্বীকার করেছেন তার মধ্যে দু’জন অন্যতম । ফকির লালন শাহ এবং মরমী কবি হাসন রাজা । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবন দেবতা চিন্তাধারায় যার গান তাকে অনুপ্রাণিত করেছিল তিনি মরমী কবি হাসন রাজা ।
সাহিত্য ও সঙ্গীত সৃষ্টির উজ্জ্বল প্রতিভা নিয়ে সুনামগঞ্জ জেলার তেঘরিয়া মৌজার লক্ষণ ছিরী গ্রামে ১৮৫৪ সালের ২৪ শে জানুয়ারি কিংবদন্তীর নায়ক হাসন রাজা জন্মগ্রহণ করেন । তার পারিবারিক নাম অহিদুর রাজা । কৈশোর পর্যন্ত তিনি এ নামে পরিচিত ছিলেন ।
পরবর্তীতে তার পিতার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু তকালীন ফার্সী ভাষার পন্ডিত নাজির আব্দুল্লাহ তার নামকরণ করেন, হাসন রাজা । তাই আজও তিনি মানুষের কাছে হাসন রাজা বলে বেঁচে আছেন । তার পিতা – দেওয়ান আলী রাজা । তার মাতা হুরমত জাহান বিবি ।
হাসন রাজার পূর্ব পুরুষরা অযোধ্যার হিন্দু অধিবাসী । পরে তার পিতামহ রাজা বাবু রায় ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়ে বাবু খান নাম গ্রহণ । করেন । বাবু খানের ছিল দুই পুত্র – আনােয়ার খান ও কিশোর খান । এই আনোয়ার খানের বংশেই হাসন রাজার জন্ম ।
হাসন রাজার পিতা আলী রাজা সরকার কর্তৃক সম্মানসূচক ‘দেওয়ান’ পদবী লাভ করেন । তদবধি এই পরিবারের সকল সদস্য নামের আগে দেওয়ান শব্দটি ব্যবহার করে থাকেন । তার পিতা জমিদারী অর্জন করেন । এবং সিলেটে সাপ্ত জমিদার পরিবারের সম্মান ও মর্যাদা লাভ করেন ।
বংশের রেওয়াজ অনুযায়ী তিনি প্রথমে এক মৌলভী সাহেবের নিকট আরবী ভাষা এবং একজন হিন্দু পন্ডিতের নিকট বাংলা ভাষা শিক্ষা করেন । হাসন রাজা কোনো বিদ্যালয়ে শিক্ষা লাভ করেননি । হাসন রাজার বয়স যখন ১৫ তখন তার পিতৃ বিয়োগ ঘটে । তাই সংসারের গুরু দায়িত্ব তাকে বহন করতে হয় । তাই পারিবারিক শিক্ষা ছাড়া । আর কোনো শিক্ষায় তিনি অগ্রসর হতে পারেননি ।
হাসন রাজা উত্তরাধিকারী হিসেবে পিতার ভূসম্পত্তির অধিকারী হন। তিনি অত্যন্ত দুর্দান্ত জমিদার হিসেবে পরিচিত ছিলেন । কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি ছিলেন উদার ও কোমল স্বভাবের অধিকারী । তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমসাময়িক এবং বয়সে তার চেয়ে বছর কয়েক বড় ।
সাধারণ লোক তাকে সাহেব বলে সম্বোধন করত । হাসন রাজা বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন । তিনি ছিলেন সৌখিন জমিদার, দয়ালু , কবি, গীতিকার ও দার্শনিক । হাসন রাজা যে দয়ালু ছিলেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় এভাবে আয়াতউল্লা নামে একজন লোক মিথ্যা মামলা সাজিয়ে হাসন রাজাকে বিপদাপন্ন করেছিল, কিন্তু আল্লাহর কৃপায় এই বিপদ থেকে তিনি উদ্ধার পেয়েছিলেন ।
পরবর্তী সময়ে আয়াতউল্লা খুব অভাবগ্রস্ত হয়ে পড়েন । এমন কি দিনে তার আহারও জোটে না । এরূপ দূরবস্থার খবর পেয়ে হাসন রাজা তাকে শুধু সাময়িক অর্থ সাহায্য করেই ক্ষান্ত হননি, তাকে সারাজীবন নিজ ব্যয়ে প্রতিপালনও করে ছিলেন ।
হাসন রাজা সৌখিন জমিদার ছিলেন বটে, তবে তার বাড়ি ঘর দেখলে কেউ মনে করবে না তিনি একজন জমিদার । তার বাড়িতে কোনো দালান কোঠা বা পাকা ঘরদর্জা ছিল না । পল্লীগ্রামের সাধারণ গৃহস্থবাড়ির মতো তারও ছিল মাটির ঘর, খড়ের চাল, কোনোটা বা ঢেউটিনের । জমিদার বাড়ির কোনো জওলুসের ছাপ ছিল না । তবে পরিবেশ ছিল সাধারণ এবং মনোরম । তাই তিনি প্রিয় হয়ে উঠেন সাধারণ মানুষের নিকট ।
হাসন রাজা জীবিত অবস্থায় কিছু লোক তার বাড়ি দেখতে এলে তিনি তাদের জিজ্ঞেস করলেন, কি চান আপনারা ? তারা সবাই বললো আমরা হাসন রাজার বাড়ি দেখতে এসেছি । তখন তিনি বললেন, আপনারা আমার সাথে আসেন আমি দেখিয়ে দিচ্ছি, বলে তিনি তাদেরকে গোরস্থানের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বললেন ঐ যে দেখুন আমার বাড়ি, আমার চিরদিনের আসল বাড়ি। ওরা সবাই অবাক হলো ।
হাসন রাজা জানতেন জীবনের মুসাফিরখানায় মায়া মমতায় আবদ্ধ হয়ে থাকার কোনো সার্থকতা নেই। তাই তিনি রচনা করেছিলেন জনপ্রিয় গান –
লোকে বলে, বলেরে –
ঘরবাড়ি ভালা নায় আমার ।
কি ঘর বানাইমু আমি শূন্যের মাঝার ।
কোনো ধরনের কৃত্রিমতা ছাড়াই অত্যন্ত সহজ সরলভাবে হাসন রাজা তার গানে হৃদয়ের অনুভূতিকেই ঠাঁই দিয়েছেন । আঞ্চলিক সুর ও কথার যে অপূর্ণ সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন তিনি তার গানে তা বাংলার ইতিহাসে বিরল । হাসন রাজা গান রচনা করতেন মুখে মুখে আর কর্মচারিরা তা লিখে রাখত । জীবনকালে তার কোনো গান পত্র – পত্রিকা বা সাময়িকীতে প্রকাশ পায়নি । তবে তার মৃত্যুর কয়েক বৎসর পূর্বে ১৯১২ সালে “হাসন উদাস” নামে একখানা বই প্রকাশিত হয় সিলেটের রহমানিয়া প্রেস থেকে ।
হাসন রাজার মৃত্যুর পর তার দ্বিতীয় সংস্করণটি প্রকাশ পায় ১৯২৪ সালে । প্রথম সংস্করণে গানের সংখ্যা ছিল বেশি তবে দ্বিতীয় সংস্করণে বেশ কিছু গানে সিলেটি ভাষার অপশব্দ থাকায় তা বাদ দেওয়া হয় । মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত হাসন রাজা প্রায় দুইশত এর উপর গান রচনা করে যান ।
যা বাংলা সাহিত্যে এক অমূল্য সম্পদ হিসেবে থাকবে । পল্লীর এই মরমী কবিকে বিখ্যাত করে তোলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ ‘হাসন উদাস’ দ্বিতীয় সংস্করণটি পড়ে ১৯২৫ সালে ভারতের দার্শনিক কংগ্রেসের সভায় দু’টি গান উদ্ধৃত করেছিলেন । অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে বক্তৃতা দেওয়ার সময় রবীন্দ্রনাথ সেই গানগুলির দু’টি পংক্তির ইংরেজি তরজমা করেন –
The sky the earth are born my own eyes
The hardness and softness
The cold and the heat are
Products of my own body
The sweet smell and the bad
Smell are my own nostril.
এর বাংলা অনুবাদ হচ্ছে –
“মম আঁখি হইতে পয়দা আসমান জমিন
শরীলে করিল পয়দা শক্ত আর নরম
আর পয়দা করিয়াছে ঠাণ্ডা আর গরম
নাকেতে করিল পয়দা খোশবয় বদবয়
অপর গানটি হচ্ছে –
‘ I have seen the vision
The vision of mine own revealing itself
Coming out from within me .’
এর বাংলা অনুবাদ হচ্ছে –
‘রূপ দেখিলাম রে, নয়নে রূপ দেখিলামরে
আমার মাঝে তো বাহিরিয়া
রূপ দেখা দিল মোরে । ”
হাসন রাজা গান রচনা করতেন রাতে খাওয়া দাওয়ার পর । গান রচনা করে নিজেই আঞ্চলিক ভাষায় সুর দিয়ে গায়িকাদের দ্বারা গাওয়াতেন । গানের সাথে তিনি নিজেই তবলা ও ঢোলক বাজাতেন । পুথিগত বিদ্যা ছিলোনা হাসন রাজার তবে তার গান অশান্ত মানুষকে শান্ত করেছিল । তাই হাসন রাজার সমতুল্য দ্বিতীয় আর একজন বাউল কবির সন্ধান পাওয়া যায় কিনা সন্দেহ ।
হাসন রাজার আরেকটি প্রকাশিত গ্রন্থ হচ্ছে ‘সৌখিন বাহার’ । রচনা খানিতে নারী দেহের বর্ণনা প্রচুর । তার অপ্রকাশিত গ্রন্থ হচ্ছে হাসন বাহার’ যা আজও প্রকাশ পায়নি ।
হাসন রাজা বহু বিবাহে আবদ্ধ হন । ১২৯৫ বাংলা সাজিদা বানুকে প্রথম বিয়ে করেন । নারীদের প্রতি হাসন রাজার দুর্বলতা ছিল প্রচুর । তাই তিনি দেশে দেশে বিয়ে করে সুন্দরী স্ত্রীদের এনে অন্দরের শোভা বর্ধন করেন । একথা তিনি অকপটে নিজেই বলে গেছেন । আইন সিদ্ধ বিবাহ হোক বা না হোক, যাদের সঙ্গে দাম্পত্য সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে, তাদের সকলকেই তিনি স্ত্রী বলে মেনে নিয়েছেন ।
হাসন রাজার বেশ কিছু শখ ছিল – নৌকাবাইচ, হাওরে গিয়ে মাছ ধরা, ‘কুড়া পাখি শিকার, দোয়েল পাখি পোষা এবং দাবা খেলা ইত্যাদি । হাসন রাজার কাব্য প্রতিভার একমাত্র উত্তরাধিকার ছিলেন একমাত্র পুত্র দেওয়ান একলিমুর রেজা । তিনি বহুগান লিখে সুনাম অর্জন করেছেন । হাসন রাজা অত্যন্ত সুদর্শন পুরুষ ছিলেন । তার উদারতা ও দানশীলতা সম্পর্কে বহু কিংবদন্তী আছে । এই কৃতি পুরুষ ১৯২২ সালে মৃত্যু বরণ করেন । ( ২২ শে অগ্রহায়ণ ১৩২৯ বাংলা ) মৃত্যুর পর তাহার পারিবারিক গোরস্থান গাজির দরগায়ে সমাহিত করা হয় । হাসন রাজার স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে রেডিও বাংলাদেশ সিলেট কেন্দ্র ৩০ মিনিট স্থিতি সম্পন্ন একটি বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করে তার মৃত্যুবার্ষিকীতে । হাসন রাজা আমাদের মধ্যে নেই, তবে তার গান আমাদের জাতীয় সম্পদ হয়ে থাকবে ।