সার্বিক সাফল্যের সুউচ্চ পাহাড় চূড়ায় উঠতে গিয়ে জীবনের সিঁড়ি বেয়ে পথ চলার দিনগুলোতে উনিশ‘শ উনাশির একটা দিনে প্রথম ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেই এমসি কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য। শ্রদ্ধেয় রইছ উদ্দিন আহমদ স্যারের কক্ষে ডাক পড়লো আমার সিরিয়েল অনুযায়ী। বুক দুরু দুরু করছে।
ভয়ে অনেকটা যেন হাত পা কাঁপছে। মুখে কথা বসে যাচ্ছে। ভয় একটাই: যদি ভর্তি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হই, তা‘হলে আমার স্বপ্নে কল্পনায় গল্প সাজানো এমসি কলেজে ভর্তি হতে পারবো না।
এরচেয়ে বড় দুঃখের বিষয় আর কী হতে পারে ! রইছ উদ্দিন স্যার ছিলেন ইসলামী শিক্ষার অধ্যাপক।
লম্বা চুলওয়ালা ছাত্রদের তিনি ভাল পেতেন না বলে শুনেছি। আর লম্বাচুলা মাথায় যারা ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে, হয়তো তাদের চুল কেটে আসার নির্দেশ দেয়া হয়েছে অথবা অযোগ্য গণ্য করা হয়েছে বলে প্রচলিত রয়েছে। আমার তো আরো ভয়, কারণ আমার মাথায় কবি নজরুলের চেয়েও লম্বা বাবরী চুল। অতএব !
কিন্তু স্যার এ সম্পর্কে আমাকে কিছুই বলেননি। তাঁর প্রশ্নগুলোর মধ্যে আমি ইসলামিয়াতে এস এস সি-তে কত নম্বার পেয়েছি তা ছিলো উল্লেখযোগ্য। প্রসঙ্গত: এস এস সি পরীক্ষার মার্কশীটে ইসলামিয়াতে আমার প্রাপ্ত নম্বার ছিলো এক‘শর মধ্যে আশি। সম্ভবত: স্যার এজন্য কিছু খুশী ছিলেন আমার উপর।
কলেজ ছাত্রাবাসে সিট পাওয়ার জন্য আবার একটা ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে হলো। বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক শ্রদ্ধেয় মনোহর আলী স্যারের কক্ষে ডাক পড়লো ইন্টারভিউ-এ। সিলেটের একটা সাপ্তাহিক পত্রিকার নাম বলতে প্রশ্ন করায় ঐদিনকার একটা পত্রিকার কপি বের করে আমার প্রকাশিত লেখাটিও দেখিয়ে দিলাম। ছাত্রাবাসেও আসন পেয়ে গেলাম অনেক প্রতিযোগিতার ভিড়ে।
আমার মধ্যকার বহুদিনের লালিত স্বপ্ন: টিলাগড়ের টিলাময় এলাকাতে টিলায় টিলায় ঘেরা বহু ঐতিহ্যের লালন ভূমি শত বর্ষের এম সি কলেজের একজন গর্বিত ছাত্র হয়ে জীবনের প্রত্যাশিত সাফল্যের চূড়ামনিতে আরোহনের সিঁড়ি বেয়ে যেন উঠতে লাগলাম।
আউলিয়া শিরোমণি হযরত শাহজালালের পূণ্যভূমি আর শ্রীভূমি সিলেটের ঐতিহ্যবাহী এমসি কলেজ। অনেক স্বনামখ্যাত ব্যক্তিত্বের জন্ম দিয়েছে এই কলেজ।
টিলাগড়ের চৌমুহনা পেরিয়েই দেয়াল বেষ্টিত টিলায় টিলায় যে সব ছোট বড় ভবন দাঁড়িয়ে আছে, এইতো এমসি কলেজ। টিলার উপরে সিঁড়ি বেয়ে উঠেই আপন গৌরবে শির উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে কলা ভবন। তার আগেই হাতের ডানে বাংলা বিভাগের ঢেউটিনের চৌচালা ঘর, বিজ্ঞানাগার। বাম দিকে মনোবিজ্ঞান বিভাগের ভবন।
একটু পরেই ছাত্রী মিলনায়তন এবং অধ্যক্ষ ভবন, অফিস এবং অধ্যাপক মিলনায়তন। পিচঢালা কালো পথে বাঁয়ে মোড় নিলে কলেজের পেছন দিকে একটা ছোট্ট ডাকঘর এবং সুউচ্চ টিলার উপর অধ্যক্ষের বাসভবন। আর ডানে মোড় নিলেই সামনে পড়বে বিরাট পুকুর। যেখানে লালপদ্ম থোকা থোকা ফুটে রয়েছে।
তার ডান পাড়ে বোটানিক্যাল গার্ডেন, মিলনায়তন, উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের ভবন। ডান দিকে রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, পাঠাগার আর ছাত্র মিলনায়তন। পুকুরের উত্তর পাড়ে ছাত্র রাজনীতি আর দাবী আদায়ের আন্দোলনের সুতিকাগার, কলেজ ক্যাণ্টিন। কলেজ আঙ্গিনায় এখানে ওখানে পাম, ইউক্যালিপ্টাস, রেনটি, সেগুন আর অনেক অনেক দিনের পুরনো সেই বিদ্যাপতি গাছ।
আসলে এমসি কলেজের আঙ্গিনা, টিলা, গাছ গাছালি, বাগান আর ভবনগুলো যেন একটা ‘পটে আঁকা ছবি‘। ঠিক যেন সুন্দরী রমণীর শাড়ীর সাথে ম্যাচ করা ছায়া, ব্লাউজ,খোপায় তারার ফুল, আর কপালে টিপ, পায়ে আলতা। ভবনগুলোতে উঠতে হলে সিঁড়ি বেয়ে টিলা বেয়ে উপরে উঠতে হয়-জীবনের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠার এ যেন আরেক প্রশিক্ষণ-আরেক শিক্ষা।
এই কলেজের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর মনোমুগ্ধকর পরিবেশ দেখে মনের আবেগে ১৯৪৫ সালে সরজিনী নাইডু বলেছিলেনঃ ‘এ কলেজে যারা পড়ে তারা সবাই কেন কবি হয়না ?‘
পুকুরের উত্তর পাড় দিয়ে আরো সামনে গেলেই আবার ডানে বায়ে কলেজের অপর ভবনসমূহ। সিঁড়ি বেয়ে টিলা উঠতে আবার নামতে ছোট্ট একটা নালার মতো খাল পেরিয়েই আবার কলেজ। কিন্তু এ কলেজ চলে ভিন্ন পরিচালনায়। তখন (১৯৭৯-৮১ আমার পাঠ্যসময়ে) এ অংশের নাম ছিলো এমসি ইন্টারমিডিয়েট কলেজ। ১৯৭৯ সালে এ কলেজে অধ্যয়ন শুরু করি এবং ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত মুল এমসি কলেজে অধ্যয়ন করি।
ভর্তির মতোই একদিন যোগ দিলাম দাবী আদায়ের মিছিলে। মিছিলে কে বা কারা নিয়ে আসলো সামন থেকে আরো সামনে জানি না। তবে ১৯৭৪ সালের পরে (এমসি ইন্টারমিডিয়েট কলেজে) দীর্ঘ বিরতির পর যে ছাত্রসংসদ নির্বাচন হলো ১৯৮০ সালে তাতে ছাত্রসংসদের সাধারণ সম্পাদক তথা জিএস নির্বাচিত হয়ে গেলাম কেমন যেন একটা ধাধার মতো।
লেখাপড়ার চেয়ে বেশী আগ্রহ নিয়ে ঝুকে গেলাম এদিকে। কলেজের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগীতা, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সপ্তাহ, কলেজ ম্যাগাজিন, বার্ষিক মিলাদ, এক কথায় প্রতিটি কর্মকান্ড নিয়ে যেমন মেতে উঠলাম তেমনি কলেজের বিভিন্ন উন্নয়নে আর দাবী আদায়ের মিছিলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চললাম।
মনে পড়ে, এমসি ইন্টারমিডিয়েট কলেজে ডিগ্রী ক্লাস চালু, ছাত্রছাত্রীদের যতায়াতের জন্য বাস বা পরিবহণ ব্যবস্থা, ইত্যকার বেশ কিছু দাবী নিয়ে সে সময় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা তখনকার প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমানের সাথে আমাদের ছাত্র সংসদ প্রতিনীধি দলের দাবী না মানায় বেশ নাজুক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিলো।
কলেজ ছাত্রসংসদের মাসিক বৈঠকে বসে কলেজের তখনকার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ শ্রদ্ধেয় জনাব নুরুল গনি (অধুনা মরহুম) স্যার কৌতুক করে বলতেন ঃ মিটিং নট সাকসেসফুল উইদাউট ইটিং। আতএব ছোট খাটো একটা চা পর্ব প্রথমেই করে নিতে হতো, পরে স্যার লজ্জা দিয়ে দেবেন এই ভয়ে।
ছাত্রাবাসের খাবার ঘরের প্রতি ছিলো দারুন অরুচি। তাই সহপাঠি মাহমুদ আলী, রায়হান, আলাউদ্দিন ভাই গং মিলে টিলাগড়ের শাপলাবাগে এক বন্ধুর বাসায় প্রায় দিনই জোর করে অতিথি হয়ে যেতাম। অবশেষে এইচ এস সি পরীক্ষা শেষ করে ছাত্রাবাসের ঐতিহাসিক পাতলাপানির ডাল খাবারকে লম্বা একটা সালাম দিয়ে চলে এসেছিলাম।
বর্তমান এমসি তথা মূল এমসি কলেজে আমরা যখন পড়ি (১৯৮২-৮৪) তখন তার নাম ছিলো সরকারী কলেজ। সবাই এ দুটি কলেজকে ডিগ্রী কলেজ এবং ইন্টারমিডিয়েট কলেজ বলে সাধারণত ডাকতেন। এ যেন ছিলো ডাক নাম। এ কলেজে অধ্যয়নকালীন আমার বশেী যাতায়াত ছিলো মুলত: বাংলা বিভাগ আর মনোবিজ্ঞান বিভাগে।
বাংলা বিভাগের শ্রদ্ধেয় আমীর আলী স্যারের কণ্ঠে ‘আমার যে সব দিতে হবে সে তো আমি জানি, আমার যত দুঃখ ব্যথা আমার যত গ্লানি’ রবীন্দ্র সঙ্গীতটি আজো আমি যেন কান পেতে শুনি। মনোবিজ্ঞান বিভাগের ক্লাশে শ্রদ্ধেয় আবদুল হালিম স্যারতো মনে করতেন আমিও ঐ ক্লাশের ছাত্র। তাই মাঝে মাঝে আমাকে এটা সেটা প্রশ্নও করে বসতেন।
অবশ্য অবশেষে একদিন নাম রেজিষ্টারে উপস্থিতি রেকর্ড শেষে আমাকে তাঁর স্বভাবসুলভ গুরুগম্ভীর কণ্ঠে দাঁড়াতে বলেন। আমি বিষয়টি আঁচ করে ফেলি তাৎক্ষনিক ভাবেই। তাই স্যারের আর কোন প্রশ্ন করার পূর্বেই বলে উঠিঃ স্যার, আপনার এ ক্লাসটি আমার খুব ভালো লাগে তাই অবৈধভাবে…… ।
স্যার হেসে ফেলেন এবং বলেন, তুমি কি করে বুঝলে যে আমি ধরতে পেরেছি তুমি এ ক্লাসের ছাত্র নও এবং এই প্রশ্নটিই করবো ? উত্তরে আমি বিনয়ের সাথে বলেছিলাম, স্যার আমি যে আপনার মনোবিজ্ঞান ক্লাসের নিয়মিত ভক্ত। সবাই এ জবাবে জোরে হেসে উঠেছিলো। অবশ্য এই ক্লাসে এ রকম ছাত্র না হয়ে অবৈধভাবে যেতে তিনি বারণ করেছিলেন আমাকে।
বাংলার ক্লাসে সেদিন শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক সফিউদ্দিন স্যার কক্ষে ঢুকেই একজন একজন করে উপস্থিত সকল ছাত্র-ছাত্রীকে একের পর এক দাঁড় করালেন। প্রশ্ন একটাইঃ তারাশংকর বন্দোপাধ্যায়ের ‘গণদেবতা‘ বইটা পড়েছো ? দুর্ভাগ্যজনকভাবে সবার উত্তরই সেদিন ছিলো ‘না‘বাচক।
আমাকে মধ্যখানে রেখে আমার পরের জনকে দাঁড় করালেন। শুধু আমি বসে আছি। আর সমস্থ ক্লাসের সবাই দাঁড়ানো। আমার বুকটা ধড়পড় করছে। এক পর্যায়ে আমি ঘেমে গেছি। ছাত্রছাত্রী সবার দৃষ্টি তখন আমার দিকে। স্যার এ প্রশ্ন কেন আমাকে করছেন না সবাই হয়তো তা ভাবছে। অবশেষে অত্যন্ত গম্ভীর ভাবে স্যার আমার দিকে অংগুলী নির্দেশ করে বললেন, বাবুল নিশ্চয়ই পড়েছ ?
আমি দাঁড়িয়ে দুহাত জোড় করে মাথা নিচু করে ঘরের মেঝের দিকে চেয়ে রয়েছি। স্যারের রূপ দেখিনি তবে অনুমান করতে পেরেছিলাম। ‘তা তোমরা পড়বে কেন? তা তোমরা পড়বে কেন?‘ বলতে বলতে ধড়াধড় করে স্যার ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। এদিনের ক্লাস নিলেন না। এরপরে আরো তিনদিন স্যার আমাদের ক্লাসে আসেননি। অবশ্য পরে আমরা কয়েকজন স্যারের বাংলা বিভাগীয় কক্ষে গিয়ে এরই মধ্যে ‘গণদেবতা‘ পড়ে নিয়েছি তা বলার পর থেকে স্যার ক্লাস নিতেন।
জীবনের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে গিয়ে সাফল্য লাভে ব্যর্থ হলেও আমার কল্পনার এবং বহু কাঙ্খিত এমসি কলেজে অধ্যয়ন করে ধন্য হয়েছি। এটা গর্বের সাথে বলতে পারি। আর স্মৃতিময় আগামী জীবনের প্রতিটি সিঁড়িতে পা রাখতে রাখতে শুধু সাত সমুদ্দুর তেরো নদীর অপারে কেন পৃথিবীর যে কোন স্থানে থেকেও স্মৃতি থেকে সেই টিলায় টিলায় সিঁড়ির কথা ভুলতে পারবো না।