প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ ব্যবস্থা প্রবর্তন করে একটি কার্যকর রাষ্ট্র গঠন করা অপরিহার্য – ডক্টর এম এ মোশতাক


বাংলাদেশে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ ব্যবস্থা প্রবর্তন করে একটি কার্যকর রাষ্ট্র গঠন করা যে অপরিহার্য, এই যুক্তির সাথে একমত পোষণ করার অনেক কারণ রয়েছে।
এই ধারণাটি কেবল একটি প্রশাসনিক পরিবর্তন নয়, বরং এটি দেশের সামগ্রিক সুশাসন, উন্নয়ন এবং জনগণের ক্ষমতায়নের জন্য একটি মৌলিক পদক্ষেপ।
কেন প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ অপরিহার্য?
১. সেবা প্রাপ্তি সহজীকরণ ও দক্ষতা বৃদ্ধি: বর্তমানে অনেক সেবার জন্য মানুষকে রাজধানী বা বিভাগীয় শহরে ছুটতে হয়। এতে সময়, অর্থ এবং শ্রমের অপচয় হয়। প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ হলে বিভাগীয় বা স্থানীয় পর্যায়ে সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলো স্থানান্তরিত হবে, ফলে মানুষ নিজ এলাকাতেই প্রয়োজনীয় সেবা পাবে। এতে সেবার মান উন্নত হবে এবং প্রশাসনের দক্ষতা বাড়বে।
২. স্থানীয় উন্নয়নে গতি ও জনঅংশগ্রহণ: স্থানীয় সরকার শক্তিশালী হলে প্রতিটি অঞ্চলের নিজস্ব প্রয়োজন অনুযায়ী উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে। জনগণ সরাসরি তাদের এলাকার উন্নয়নে অংশ নিতে পারবে, যা দীর্ঘমেয়াদী টেকসই উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য। এতে স্থানীয় সম্পদ ও মেধার সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত হবে।
৩. ক্ষমতার ভারসাম্য ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা: ক্ষমতা যখন কেবল একটি কেন্দ্রে কেন্দ্রীভূত থাকে, তখন তা আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, দুর্নীতি এবং স্বজনপ্রীতির জন্ম দিতে পারে। বিকেন্দ্রীকরণ হলে ক্ষমতা স্থানীয় পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়বে, যা ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করবে। এতে জনপ্রতিনিধি এবং সরকারি কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতা বাড়বে, কারণ তারা জনগণের কাছাকাছি থাকবে এবং তাদের কাছে সরাসরি দায়বদ্ধ থাকবে।
৪. দুর্নীতি হ্রাস ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা: যখন সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং বাস্তবায়নের ক্ষমতা স্থানীয় পর্যায়ে থাকে, তখন স্বচ্ছতা বাড়ানো সহজ হয়। স্থানীয় পর্যায়ের মানুষ প্রশাসনের উপর আরও বেশি নজরদারি করতে পারে, যা দুর্নীতি কমাতে সহায়ক হবে। এটি সামগ্রিকভাবে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।
৫. আঞ্চলিক বৈষম্য হ্রাস: বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে উন্নয়নের ক্ষেত্রে ব্যাপক বৈষম্য বিদ্যমান। বিকেন্দ্রীকরণ এই বৈষম্য কমাতে সাহায্য করবে, কারণ প্রতিটি অঞ্চল তার নিজস্ব সম্পদ এবং প্রয়োজন অনুযায়ী উন্নয়নের সুযোগ পাবে। এতে সুষম উন্নয়ন সম্ভব হবে।
চ্যালেঞ্জ এবং পথচলা:
প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ নিঃসন্দেহে একটি জটিল প্রক্রিয়া এবং এর বাস্তবায়নে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যেমন – পর্যাপ্ত অবকাঠামোর অভাব, বিশেষজ্ঞ জনবলের অভাব, এবং আর্থিক সংস্থান। তবে, একটি কার্যকর রাষ্ট্র গঠনের জন্য এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করে সামনে এগিয়ে যাওয়া জরুরি। এর জন্য প্রয়োজন শক্তিশালী রাজনৈতিক সদিচ্ছা, সুপরিকল্পিত রোডম্যাপ, পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ, এবং জনপ্রশাসন ও সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক জনসচেতনতা তৈরি করা।
প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ শুধু একটি তত্ত্ব নয়, এটি একটি বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ যা বাংলাদেশের মতো একটি জনবহুল এবং বৈচিত্র্যময় দেশের জন্য আরও শক্তিশালী, স্থিতিশীল এবং জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ রাষ্ট্র গঠনের পথ প্রশস্ত করতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *