বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা কেমন হওয়া উচিত, তা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা ও বিতর্ক রয়েছে। তবে, একটি উন্নত, যুগোপযোগী এবং কার্যকর শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য কিছু মৌলিক দিক অবশ্যই অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে উঠে একটি সুদূরপ্রসারী ও ফলপ্রসূ শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য নিম্নলিখিত বিষয়গুলো বিবেচনা করা যেতে পারে:১. মুখস্থনির্ভরতা থেকে বের হয়ে সৃজনশীল ও বিশ্লেষণধর্মী শিক্ষা:
* সৃজনশীলতা ও সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনার বিকাশ: শিক্ষার্থীরা যেন কেবল মুখস্থ না করে, বরং শিখনের বিষয়বস্তু বিশ্লেষণ করতে এবং নিজেদের মতো করে চিন্তা করতে শেখে। সমস্যা সমাধানের দক্ষতা (Problem Solving Skills) বাড়ানোর উপর জোর দিতে হবে।
* ব্যবহারিক শিক্ষা ও হাতে-কলমে শেখা: তাত্ত্বিক জ্ঞানের পাশাপাশি ব্যবহারিক শিক্ষার উপর গুরুত্ব দিতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীরা বাস্তব জীবনে অর্জিত জ্ঞান প্রয়োগ করতে পারে। বিজ্ঞান, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় ল্যাব ও কর্মশালার সুযোগ বাড়াতে হবে।
২. মানসম্মত শিক্ষক তৈরি ও তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি:
* শিক্ষকদের উচ্চমানের প্রশিক্ষণ: শিক্ষকদের নিয়মিত ও যুগোপযোগী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে তারা আধুনিক শিক্ষাদান পদ্ধতি ও প্রযুক্তির সাথে পরিচিত হতে পারেন।
* আকর্ষণীয় বেতন ও সুযোগ-সুবিধা: মেধাবী ও যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিরা যাতে শিক্ষকতা পেশায় আসতে আগ্রহী হন, সেজন্য শিক্ষকদের বেতন-ভাতা ও সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি করতে হবে।
* স্বচ্ছ নিয়োগ প্রক্রিয়া: শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ ও দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে, যাতে প্রকৃত যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিরা শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হতে পারেন।

৩. যুগোপযোগী পাঠ্যক্রম ও মূল্যায়ন পদ্ধতি:
* আধুনিক ও আন্তর্জাতিক মানের পাঠ্যক্রম: পাঠ্যক্রমকে এমনভাবে ঢেলে সাজাতে হবে, যাতে তা বর্তমান বিশ্বের চাহিদা এবং ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শিক্ষার্থীদের প্রস্তুত করতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তন, ডিজিটাল সাক্ষরতা, লিঙ্গ সমতা, সামাজিক অন্তর্ভুক্তি ইত্যাদি বিষয় পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
* সামগ্রিক মূল্যায়ন পদ্ধতি: শুধু পরীক্ষার ফলাফলের উপর নির্ভর না করে, শিক্ষার্থীর সামগ্রিক পারফরম্যান্স (যেমন: সৃজনশীল কাজ, দলগত কাজ, আচরণ, নৈতিকতা) মূল্যায়নের আওতায় আনতে হবে। নতুন কারিকুলামে যে শিখনকালীন মূল্যায়নের কথা বলা হয়েছে, তার সফল বাস্তবায়ন জরুরি।
* জীবনমুখী ও কর্মমুখী শিক্ষা: শিক্ষার্থীদের কর্মজীবনের জন্য প্রস্তুত করার লক্ষ্যে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার উপর জোর দিতে হবে। শিল্প খাতের চাহিদার সাথে সঙ্গতি রেখে কারিগরি শিক্ষার মান উন্নয়ন করতে হবে।
৪. শিক্ষার সর্বস্তরে সমতা ও প্রবেশাধিকার নিশ্চিতকরণ:
* বৈষম্য দূরীকরণ: শহর ও গ্রামের শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্য দূর করতে হবে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর অবকাঠামো উন্নয়ন এবং মানসম্মত শিক্ষক নিশ্চিত করতে হবে।
* বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা: প্রতিবন্ধী ও বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের জন্য বিশেষ উপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা, পাঠ্যক্রম ও প্রশিক্ষিত শিক্ষক নিশ্চিত করতে হবে।
* ঝরে পড়া রোধ: দারিদ্র্য, সামাজিক কুসংস্কার বা অন্যান্য কারণে যাতে কোনো শিশু শিক্ষা থেকে ঝরে না পড়ে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। উপবৃত্তি, মিড ডে মিল, অভিভাবকদের সচেতনতা বৃদ্ধি ইত্যাদি পদক্ষেপ কার্যকরী হতে পারে।
৫. শিক্ষার সর্বস্তরে প্রযুক্তির ব্যবহার:
* ডিজিটাল শিক্ষা ব্যবস্থা: প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ইন্টারনেট সংযোগ, মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম এবং কম্পিউটার ল্যাবের ব্যবস্থা করতে হবে।
* শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ডিজিটাল দক্ষতা বৃদ্ধি: ডিজিটাল টুলস এবং অনলাইন লার্নিং প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
* ওপেন লার্নিং প্ল্যাটফর্ম: একটি জাতীয় “ওপেন লার্নিং প্ল্যাটফর্ম” গড়ে তোলা যেতে পারে, যেখানে শিক্ষার্থীরা বিনামূল্যে মানসম্মত শিক্ষা উপকরণ পেতে পারবে।

৬. গবেষণার সুযোগ বৃদ্ধি:
* উচ্চশিক্ষায় গবেষণা: বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গবেষণার সুযোগ বৃদ্ধি করতে হবে এবং এর জন্য পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে। গবেষণাভিত্তিক প্রকাশনাকে উৎসাহিত করতে হবে।
* শিল্প-শিক্ষা সংযোগ: শিল্প ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে, যাতে ব্যবহারিক গবেষণা এবং শিল্প খাতের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ জনশক্তি তৈরি হয়।
৭. নৈতিকতা ও মূল্যবোধের শিক্ষা:
* চরিত্র গঠন: কেবল জ্ঞান অর্জনের পরিবর্তে শিক্ষার্থীদের মধ্যে নৈতিকতা, সততা, দেশপ্রেম এবং মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত করতে হবে।
* সামাজিক দায়িত্ববোধ: শিক্ষার্থীদেরকে সামাজিক দায়িত্ববোধ সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে হবে এবং তাদের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও সহমর্মিতার মনোভাব গড়ে তুলতে হবে।
৮. শিক্ষা খাতে বাজেট বৃদ্ধি ও সুশাসন নিশ্চিতকরণ:
* জিডিপির আনুপাতিক হারে বরাদ্দ বৃদ্ধি: শিক্ষা খাতে পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে। বর্তমানে বাংলাদেশের শিক্ষা খাতে জিডিপির যে অংশ ব্যয় হয়, তা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের তুলনায় কম।
* দুর্নীতিমুক্ত শিক্ষা প্রশাসন: শিক্ষা প্রশাসনের প্রতিটি স্তরে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে এবং দুর্নীতি সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করতে হবে।
উপরে উল্লিখিত বিষয়গুলো যদি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ভবিষ্যতে আরও গতিশীল, কার্যকর এবং মানবসম্পদ উন্নয়নের অন্যতম প্রধান চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করতে পারবে। এটি দেশকে সমৃদ্ধি ও টেকসই উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে সহায়ক হবে।
