কত যে নগরি, সভ্যতা হয়েছে বিলিন সময়ের ও পরিবেশের বৈরি পদ দলে তার হিসাব কে রাখে ? ইতিহাসের পম্পে নগরীর খবর কত জনই বা জানেন ? যা চলে গিয়েছিল মহা সাগররে গর্ভে।

আমার ঠিকানা যে নামের সাথে জড়িত তারও ইতিহাস ঐতিহ্য হয়েছে বিলিন। সে তো আজ নদী গর্ভে এক পুরাতন আখ্যান। তেমনি একটা নাম ও স্থান হল, মনু মুখ।

জায়গাটার নাম করন করা হয়েছে ঐতিহাসিক মনু নদীর মুখকে গিড়ে। মনু নদীর এক মুখ এখানে এসে কুশিয়ারায় পড়েছে। তাই এই জায়গার নাম করন করা হয়েছে মনু মুখ।

মনু নদীর ইতিহাস বলে, হাজার বছর ব্যাপি হিন্দু ধর্মের লোকেরা পবিত্রতা অর্জন করার জন্য মঙ্গল আরচনা গোসল করে আসছেন। মনু তাদের কাছে পবিত্র নদী। ভৌগলিক ইতিহাস এবং এর অবস্থানগত কারণে এটা সেই প্রাচীন কাল থেকেই নদী বন্দর। স্টিমার ও লঞ্চ আসার বহুদিকাল পূর্ব হতে বণিকরা বড় বড় সওদাগরি নৌকা এই বন্দরে ভিরাত।

মেঘনা কুশিয়ারা বাহি নৌযান গুলি মনু বন্দরে ভিরে, তার মুখ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে উজানে বিভিন্ন ব্যবসায়িক স্থানসহ যেমন কৈলাসর (ত্রিপুরা, ইন্ডিয়া) যেত। তৎসময়ে ধনী ব্যবাসায়ি বলতেই বড় সদাগরি নৌকার মালিককেই বুঝাত। অধুনা শহর বন্দর গড়ে উঠার আগে সব উন্নয়ন ও সভ্যতা ছিল নদী মাতৃক। রাস্তা বলতে জল পথ। সেটা বাণিজ্যই হউক বা চলা চলেরই হউক। সবই হত নদী পথে। যে কাচা পাকা রাস্তা ছিল তা পরিমান ও ব্যাবহারের দিক দিয়ে ছিল অতি নগণ্য।

মনু মুখ পাটের জন্য সারা পাকিস্তানে মধ্যে ছিল ছিল সুপরিচিত। পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী সোনালি আঁশ এখান থেকেই পক্রিয়া করন হয়ে সরাসরি জাহাজে উঠে চলে যেত আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে।

৫০ এর দশকে প্রাথমিক শিক্ষার ভূগোল পাঠ্যসূচিতে মনু মুখ বাজারের উল্লেখ্য ছিল। মহকুমা শহর মৌলভী বাজার থেকে বাস লাইন ৬০ এর দশকে এখানে এসেছিল। রাস্তাটা পিচ না করে পাথর বিছিয়ে করা হয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তানের বিখ্যাত নদী বন্দর, যেখানে স্টিমার ও লঞ্চ ঘাট ছিল।পুরাতন ইতিহাস ও ম্যাপ ঘাঁটলে মনু মুখ কে নদী বন্দর হিসাবে দেখা যায়।

মৌল্ভী বাজার সিলেট সড়কের, কাজির বাজার ট্রানিং থেকে একটি রাস্তা সোজা উত্তর এসে মনু মুখ হাই স্কুলটাকে উত্তর পাশে রেখে পূর্বমখী হয়ে বামে মোড় দিয়ে বাজারে প্রবেশ করেছে। ঢাকা সিলেট মহা সড়কের কাজির বাজার বাঁকে মনু মুখ মাইল ফলক ও দুরত্ব লেখা ছিল। মনু নদীর মুখের পশ্চিমে ও কুশিয়ারা নদীর উত্তরে এই বিখ্যাত বন্দরের অবস্তান। সোজা কথায় মনু নদী ও কুশিয়ার নদী মিশে যেখানে ৯০ ডিগ্রি সৃষ্টি করেছে এবং কর্নার থেকে বাজারের দূরত্ব ছিল মনু নদীর মুখের পাড় থেকে পশ্চিমের দুরত্বের অর্ধেক দুরত্বে ছিল কুশিয়ারা। এমনি মনোরম দুই নদীর জীবন চিত্রে তার ছিল গৌরবময় অবস্তান। উভয় নদীর এপার অপার এর মানুষ জনের প্রাণের স্পন্দন ছিল এই মনু মুখ।

উত্তর ও পূর্ব প্রান্তের মানুষ নদী পাড় হয়ে বাজারে আসত, বাকি সবাই বাজারের দক্ষিন পশ্চিম মুখী রাস্তা দিয়ে আসা যাওয়া করত। একাদিক খেওয়া পারাপার ছিল কুশিয়ারা নদীতে।

বাজারে হেটে বা গাড়ি দিয়ে প্রবেশ করতে বামে দিকে চোখে পড়বে লাল  টিনের তৈরি বিশালাকার পাটের গুদাম তার পূর্বে মনুমখ হাই স্কুল। স্কুলের পূর্ব-উত্তর মনু মুখ গ্রাম। এই গ্রামটা সম্পূর্ণ মৎস্য জীবীদের। গ্রাম বাসি সবাই সুখিই ছিল। আজ মাছ নেই, বাজার নেই, নৌকা নেই তাই দারিদ্রতায় জিমিয়ে জিমিয়ে মরছে মানুষ গুলি। স্কুল পাড়ি দিয়ে পূর্ব দিকে এগিয়ে পুরু মোড় নিলে, ঐ অবস্তান থেকে কোন ভাবেই পিছনে ফিরে স্কুল কে দেখা যাবে না।

স্কুল চলে যাবে ফেলে আসা বাঁকের আড়ালে। তার পর কিছুক্ষন হেঁটে হাতের ডানে পড়বে লাল টিনের লোহার খাম্বা দিয়ে তৈরি ডাক বাংলা। দক্ষিনে বেশ ফাঁকা জায়গা নিয়ে এই রেস্ট হাইস ( ডাক বাংলা)। সরকারি লোকজন আসলে থাকার ঘর।এই ডাক বাংলার মাঠে রাজনৈতিক সমাবেশ ও বক্তৃতা হতে দেখেছি। এর পূর্বে চান পুর গ্রামের শুরু। ডাক বাংলা ছেড়ে কয়েকশ গজ পর বামে রাস্তায় ডুকেই হাতের ডানে সরকারি হাসপাতাল ও পুকুর।

সোজা গেলে হাতের বামে বাজারের মসজিদ। মসজিদটি বাজার থেকে একটু কোলাহল মুক্ত স্তানে। মসজিদটি খুবই শক্ত কাঠামোর দালান ছিল। মসজিদের উত্তরে ফরেস্ট রেঞ্জ অফিস তারও অনেক উত্তরে স্টিমার ঘাট। স্টিমার ঘাটের যে পাকা বিল্ডিং ছিল সেথায় নাটক ও গান বাজনার অনুষ্ঠান হত। মসজিদের পূর্ব- উত্তর নিয়ে চতুস্কুন বেশ ফাঁকা জায়গা। যেখানে প্রতি দিন সকাল বিকেল হাট বাজার লেগেই থাকত। এখানে শত ব্যবসায়ি পসরা নিয়ে চৌকিতে বা মাটিতে বা মাদুর পাটি বিচিয়ে নানাবিদ ব্যবসা বাণিজ্য করত। সন্ধে পর দোকানিরা কুপি জ্বালালে অন্য এক আবহের সৃষ্টি হত।

প্রতিদিন দুইবার দুধ ও মাছের ডাক হত। এখানে নিদেন পক্ষে দিনে ১৫০/২০০ মন দুধ বিক্রি হত। মাছের পরিমানের কোন হিসেবই ছিল না, অনবরত আসতেছে, নদী আছে, নৌকা আছে, মাছ বাজারে উঠতেছে। আমি এমনও দেখেছি সন্ধে ঘনিয়ে গেছে তারপরও তরতাজা মাছ বাজারে উঠতেছে।

এই মহা বেস্ততায় এক ধরণের বিরাট দালাল গুষ্টি বাজার কেন্দিক সর্বক্ষণ গড়ে উঠেছিল। আশ পাশ গ্রামের কিছু লোকের আর কোন জীবিকা ছিল না ইহা ছাড়া। ওরা সকাল বেলা বাড়ি থেকে বের হয়ে আসত আর সন্ধেয় মাছ তরকারি নিয়ে বাড়ি ফিরত। আমার গ্রামের এমন একজন ছিল। সহায় সম্বল জমি জিরাত তেমন ছিল না, কিন্তু জীবন এভাবেই চালাতে দেখেছি।

পশ্চিম বাজার ও পূর্ব বাজার নামে মনু মুখ বাজার বিভক্ত ছিল। বাজারের মাজ বরাবর পূর্ব পশ্চিম বাহিত রাস্তা ছিল। রাস্তার উত্তরে কুশিয়ারা প্রান্তে বড় বড় মিস্টির দোকান ও ভেরাইটিস জিনিসের দোকান, দর্জির দুকান সহ অন্যান্য দুকান একটার পর আরেকটা ছিল।

দক্ষিন প্রান্তটা অন্য আঙ্গিকের ,মার্চেন্ট দের দোতাল বিল্ডিং ও চেম্বারের সারি। নিচে অফিস ও ব্যবসা এবং উপরে বাসস্থান। মার্চেন্ট সাড়িতে পাগরিয়া গ্রামের আব্দুর রহমান খান ( চামল খাঁ ) এর ” রেশনের” মার্চেন্ট ছিল । কেরেশিন, লবন, চিনি, তৈল সহ অন্যান্য অতি প্রয়োজনীয় জিনিষের জন্য সরকার অনুমোদিত ডিলার উনি ছিলেন। উনার ছেলে আহমেদুর রহমান খান সুপ্রিম কোর্টের প্রতিথ যশা এটর্নি ছিলেন। উনি পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নুরুল আমিনের মেয়ের জামাই। গভর্নর নুরুল আমিন এই মনুমুখ বাজারে ১৯৫৪-৫৫ এর দিকে হেলিকপ্টার দিয়ে এসেছিলেন।

সিলেট সুবিদ বাজারের সোলেমান খান এর অফিস ও ব্যাবসা ছিল এই বাণিজ্য তীরে। এর পর অন্যান্য মার্চেন্ট দের অফিস ছেড়ে মারওারি মার্চেন্ট চম্পা লাল সান্দ এর ছিল এলাহি কান্ড কারখানা। ৫ টা ব্রহদাকার পাটের গোদাম ও ৫ টা জুট মিল ছিল। দিন রাত্রি কাজ চলত শত শত মানুষের। কোলাহলে সরগরম থাকত এই প্রান্তর। কোন কোন মেশিন শ্রমিকরা হাতে চালাতা।

কোনটা চলত ডিজেল জ্বালানির মাধ্যমে। হাইড্রলিক পেসারের মাধ্যমে পাটকে আট বেঁধে এখান থেকেই জাহাজে দিয়ে পাঠানো হত ইন্ডিয়া। পূর্ব পাকিস্তানে নায়ারায়ন গঞ্জের পড়েই ছিল মনু মুখের স্তান নদী বন্ধর ও পাট ব্যবসার বিখ্যাত স্থান হিসাবে। মাড়োয়ারি ব্যবসায়ি চাম্পা লাল সান্দ এর ল্যান্ড রবার গাড়ি থাকত ওর চেম্বারের সামনে।

বাজারে ঢুকার আগে যে উচ্চ বিদ্যালয় ছিল তার উত্তরে ছিল ২টি তেলের মিল। বিশাল কর্মযজ্ঞ চলত। তেল উৎপাদন, টিন জাত করে বাজারজাত করা হত। তারও পূর্বে অবস্তান ছিল মনু মুখ সাব পোস্ট অফিসের । তেলের মিলের উত্তরে ছিল একটি প্রাইমারি স্কুল। তদুত্তরে কুশিয়ারা নদী ও নদীর অপর প্রান্তে ছিল ” স’মিল” ফাজিল পুর গ্রাম এলাকায়। বহু লোক কর্মে যুক্ত ছিল সেথায়। ১৯৪৭ এর দাঙ্গার পর থেকে এই ব্যবসার ব্যপকতা কমতে থাকে ও বিলিন হয়ে যায়।

এই বাজারে বহু আগে থেকেই অয়ারলেস ও পরবর্তীতে টেলিফোন ছিল। ১৯৭০ এর নির্বাচনে স্থানিয় হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ফনিন্দ্র কুমার ভট্টাচার্য, M.A, LLB ( ফনি বাবু ) ছিলেন ভোট কেন্দ্রের নির্বাচন অফিসার। সেই নির্বাচনে উনিই ওয়ারলেসের মাধ্যমে প্রথম কেন্দ্রে রিজাল্ট পাঠিয়েছিলেন। সেই নির্বাচনে শ্রীমঙ্গলের ইলিয়াস চৌধুরী পাশ করেছিলেন আব্দুর রহমান খানের বিপক্ষে। ইলিয়াস চৌধুরী ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাকালীন সেক্রেটারি। সেটা ছিল এম,এল, এ নির্বাচন। তখনকার এম, পি ছিলেন আব্দুল আজিজ।

আজ সেই প্রাণের মেলা, শত মানুষের জীবিকার ভেলা, সৌরভ ও গৌরবে স্থান করে নেওয়া মুনু মুখ সময়ের আস্তাচলেই হারিয়ে গিয়েছে। শুধু ফেকাশে স্মৃতি ও তার কথন মনে বাঁধে আনন্দ ও বেদনায় সুর বিহগলে। হারিয়ে গিয়েছে সব আছে শুধু নামে। অধুনা মৌলভী বাজার জেলার, একটি ইঊনিয়ন ও ভগ্ন বাজার হিসাবে।

এই লেখার অনেক গুলি তথ্য ফনি বাবু স্যারের কাছ থেকে শুনেছি। উনাকে জানাই ধন্যবাদ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here