যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন বাংলাদেশকে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করতে পারে – ডক্টর এম এ মোশতাক


যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশকে একটি উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করা অবশ্যই সম্ভব। এটি একটি সুদূরপ্রসারী এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক অগ্রগতিতে মৌলিক ভূমিকা পালন করে। নিচে কিছু মূল দিক আলোচনা করা হলো কিভাবে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন বাংলাদেশকে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করতে পারে:
১. অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি:
* দ্রুত পণ্য পরিবহন ও বাণিজ্য বৃদ্ধি: উন্নত সড়ক, রেল, নৌ এবং বিমান যোগাযোগ ব্যবস্থা দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য দ্রুত ও কম খরচে পরিবহনে সহায়তা করে। এটি অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বৃদ্ধি করে, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল চালিকা শক্তি।
* শিল্প ও কৃষি খাতের উন্নয়ন: কাঁচামাল এবং উৎপাদিত পণ্য পরিবহনে সহজলভ্যতা শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়তে উৎসাহিত করে। কৃষকদের জন্য তাদের পণ্য বাজারে নিয়ে আসা সহজ হয়, যা ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করে এবং কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করে।
* পর্যটন শিল্পের বিকাশ: উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা পর্যটকদের জন্য দেশের দর্শনীয় স্থানগুলোতে পৌঁছানো সহজ করে তোলে। এটি পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটায়, যা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
* বিনিয়োগ আকর্ষণ: ভালো যোগাযোগ অবকাঠামো দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করে। বিনিয়োগকারীরা এমন স্থানে বিনিয়োগ করতে পছন্দ করেন যেখানে পণ্য পরিবহন এবং সরবরাহ ব্যবস্থা সুসংহত।
২. কর্মসংস্থান সৃষ্টি:
* প্রত্যক্ষ কর্মসংস্থান: সড়ক, সেতু, রেললাইন, বন্দর এবং বিমানবন্দর নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণে প্রচুর কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়।
* পরোক্ষ কর্মসংস্থান: যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধি পায়, যা পরিবহন, লজিস্টিকস, হোটেল, রেস্তোরাঁ এবং অন্যান্য সেবা খাতে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করে।
৩. সামাজিক উন্নয়ন:
* শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবার প্রসার: উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং স্বাস্থ্য কেন্দ্রে পৌঁছানো সহজ করে তোলে। এটি স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নত করে এবং শিক্ষার হার বৃদ্ধি করে।
* তথ্যপ্রযুক্তির প্রসারে সহায়ক: উন্নত ইন্টারনেট অবকাঠামো এবং ডিজিটাল যোগাযোগ ব্যবস্থা তথ্যপ্রযুক্তির প্রসারে সাহায্য করে, যা ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনে সহায়ক। এটি শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সরকারি সেবাকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে সাহায্য করে।
* মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন: সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা মানুষের সময় বাঁচায়, যাতায়াতের খরচ কমায় এবং দৈনন্দিন জীবনকে আরও সহজ ও গতিশীল করে তোলে। এটি মানুষের জীবনযাত্রার সামগ্রিক মান উন্নত করে।
৪. আঞ্চলিক ভারসাম্য ও বিকেন্দ্রীকরণ:
* যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে রাজধানীমুখী প্রবণতা কমে আসে। দেশের অন্যান্য অঞ্চলে শিল্প, বাণিজ্য ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার সুযোগ তৈরি হয়, যা আঞ্চলিক বৈষম্য কমিয়ে আনে এবং সুষম উন্নয়ন নিশ্চিত করে।
৫. দুর্যোগ মোকাবেলা ও নিরাপত্তা:
* উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে ত্রাণ ও উদ্ধার কার্যক্রম দ্রুত পরিচালনা করতে সাহায্য করে। এটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং জাতীয় নিরাপত্তা জোরদারেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
উন্নতির জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ:
* আধুনিক অবকাঠামো নির্মাণ: উন্নত মানের সড়ক, রেলওয়ে, নৌপথ এবং বিমানবন্দর নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণে বিনিয়োগ।
* ডিজিটাল যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রসার: সারা দেশে উচ্চ গতির ইন্টারনেট এবং ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্কের সম্প্রসারণ।
* স্মার্ট পরিবহন ব্যবস্থা: ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, অনলাইন টিকেট এবং উন্নত লজিস্টিক সিস্টেমের প্রবর্তন।
* টেকসই উন্নয়ন পরিকল্পনা: পরিবেশবান্ধব যোগাযোগ ব্যবস্থার উপর জোর দেওয়া।
* সমন্বিত পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন: সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার মধ্যে সমন্বয় সাধন এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ।
উপসংহারে বলা যায়, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন বাংলাদেশের জন্য একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। সঠিক পরিকল্পনা, পর্যাপ্ত বিনিয়োগ এবং কার্যকর বাস্তবায়নের মাধ্যমে এই খাতকে শক্তিশালী করে তোলা সম্ভব। এটি কেবল ভৌত অবকাঠামোগত উন্নয়ন নয়, বরং একটি উন্নত, সমৃদ্ধ এবং আধুনিক বাংলাদেশ গঠনের মূল চাবিকাঠি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *