বাংলাদেশের নির্বাচন পদ্ধতি কেমন হওয়া উচিত – ডক্টর এম এ মোশতাক


বাংলাদেশের নির্বাচন পদ্ধতি কেমন হওয়া উচিত, তা নিয়ে দীর্ঘকাল ধরে আলোচনা ও বিতর্ক চলে আসছে। বর্তমানে বাংলাদেশে সংসদীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় “ফার্স্ট-পাস্ট-দ্য-পোস্ট” (First-Past-The-Post – FPTP) পদ্ধতিতে, যেখানে একটি নির্বাচনী এলাকার প্রার্থীরা ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন, যিনি সবচেয়ে বেশি ভোট পান, তিনিই বিজয়ী হন। ৫০টি আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত থাকে, যা আনুপাতিক হারে নির্বাচিত হয়।
একটি আদর্শ নির্বাচন পদ্ধতির মূল লক্ষ্য হলো:
* জনগণের প্রকৃত প্রতিনিধিত্ব: যাতে জনগণের মতামতের সঠিক প্রতিফলন ঘটে।
* গ্রহণযোগ্যতা: নির্বাচনের ফলাফল যেন সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয় এবং কোনো পক্ষ প্রশ্ন তুলতে না পারে।
* স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা: নির্বাচন প্রক্রিয়া যেন সম্পূর্ণ স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ হয়, যাতে কোনো প্রকার কারচুপি বা অনিয়মের সুযোগ না থাকে।
* স্থিতিশীলতা: একটি শক্তিশালী ও স্থিতিশীল সরকার গঠনে সহায়তা করা।
বাংলাদেশে বর্তমান নির্বাচন পদ্ধতির কিছু সীমাবদ্ধতা নিয়ে প্রায়শই প্রশ্ন ওঠে, যেমন:
* ক্ষুদ্র দলগুলোর প্রতিনিধিত্বের অভাব: FPTP পদ্ধতিতে কম ভোট পাওয়া ছোট দলগুলো প্রায়শই সংসদে স্থান পায় না, এমনকি তাদের সামগ্রিক ভোট শতাংশ বেশি হলেও।
* ভোটের অপচয়: অনেক ভোটই নির্বাচিত প্রার্থীর পক্ষে না পড়লে সেগুলোকে ‘অপচয়’ বলে মনে করা হয়।
* দলীয়করণ: নির্বাচন প্রক্রিয়ায় প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দলীয়করণের অভিযোগ ওঠে।
* অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ: সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনে বিভিন্ন সময়ে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছে।
একটি উন্নত নির্বাচন পদ্ধতির জন্য বাংলাদেশে কিছু বিষয় বিবেচনা করা যেতে পারে:
১. নির্বাচনকালীন সরকার:
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে দীর্ঘদিনের বিতর্ক রয়েছে। যদিও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়েছে, তবে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকারের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা এখনও বিদ্যমান। অনেকে মনে করেন, নির্বাচনকালীন সময়ে একটি নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বা নির্বাচনকালীন সরকারের পূর্ণ ক্ষমতা থাকা উচিত, যাতে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রভাব না থাকে।
২. নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালীকরণ:
নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা, নিরপেক্ষতা ও ক্ষমতা বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি। এর জন্য:
* নিয়োগ প্রক্রিয়া: নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ প্রক্রিয়া স্বচ্ছ ও সর্বজনীনভাবে গ্রহণযোগ্য হওয়া উচিত, যাতে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত যোগ্য ব্যক্তিরা নির্বাচিত হন।
* আইনি ও আর্থিক স্বাধীনতা: নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব বাজেট ও আইনি ক্ষমতা থাকতে হবে, যাতে তারা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে।
* জবাবদিহিতা: নির্বাচন কমিশনকে তার কাজের জন্য জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হবে।
৩. নির্বাচন পদ্ধতির সংস্কার (আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা মিশ্র পদ্ধতি):
FPTP পদ্ধতির পাশাপাশি আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (Proportional Representation – PR) পদ্ধতির বিষয়টি আলোচনায় আসে। আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতিতে একটি দল যত শতাংশ ভোট পায়, সংসদে তত শতাংশ আসন পায়। এতে ক্ষুদ্র দলগুলোর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হয় এবং ভোটের অপচয় কমে। কিছু দেশ মিশ্র পদ্ধতি (Mixed-Member Proportional – MMP) ব্যবহার করে, যেখানে কিছু আসন FPTP পদ্ধতিতে এবং কিছু আসন PR পদ্ধতিতে নির্বাচিত হয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এর সুবিধা-অসুবিধাগুলো নিয়ে আলোচনা করে একটি উপযুক্ত পদ্ধতি খুঁজে বের করা যেতে পারে।
৪. নির্বাচনী আইন ও বিধিমালার প্রয়োগ:
নির্বাচনী আইন ও বিধিমালা কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে, যাতে কোনো প্রকার নির্বাচনী অনিয়ম, যেমন – অর্থ ও পেশী শক্তির ব্যবহার, জাল ভোট, বা প্রভাব খাটানো রোধ করা যায়।
৫. কালো টাকা ও পেশী শক্তির নিয়ন্ত্রণ:
নির্বাচনে কালো টাকা ও পেশী শক্তির ব্যবহার বাংলাদেশের একটি বড় সমস্যা। এটি বন্ধ করার জন্য কঠোর আইন প্রয়োগ ও জনসচেতনতা বৃদ্ধি প্রয়োজন।
৬. গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা:
নির্বাচনের সময় গণমাধ্যম যাতে স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে তথ্য পরিবেশন করতে পারে, তা নিশ্চিত করা উচিত।
৭. ভোটার তালিকা হালনাগাদ ও স্বচ্ছতা:
একটি ত্রুটিমুক্ত ভোটার তালিকা এবং ভোটদান প্রক্রিয়া স্বচ্ছ হওয়া উচিত।
৮. ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার:
ইভিএম (Electronic Voting Machine) বা অন্যান্য ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে বিতর্ক থাকলেও, এর সঠিক ও ত্রুটিমুক্ত ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে ভোটদান প্রক্রিয়া দ্রুত ও নির্ভুল হতে পারে। তবে এর জন্য পর্যাপ্ত আস্থা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা জরুরি।
৯. রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা:
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ ও নির্বাচনকালীন সময়ে একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জরুরি। একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য দলগুলোর সদিচ্ছা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশের জন্য কোন নির্বাচন পদ্ধতি সবচেয়ে ভালো হবে, তা নির্ধারণ করতে গেলে দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন। বিভিন্ন দেশের সফল নির্বাচন পদ্ধতির অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এবং দেশের নিজস্ব চাহিদা ও সীমাবদ্ধতাগুলো মাথায় রেখে একটি কার্যকর ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন পদ্ধতির দিকে এগোনো উচিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *