বাংলাদেশের সংবিধান কেমন হওয়া উচিত – ডক্টর এম এ মোশতাক


বাংলাদেশের সংবিধান কেমন হওয়া উচিত, তা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে কিছু মৌলিক দিক বিবেচনা করা জরুরি, যা একটি আধুনিক, গণতান্ত্রিক, এবং জনমুখী রাষ্ট্রের ভিত্তি তৈরি করবে। একটি আদর্শ সংবিধানকে দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি, মূল্যবোধ, এবং ভবিষ্যৎ আকাঙ্ক্ষার প্রতিচ্ছবি হতে হয়।
সংবিধানের মূলনীতি ও বৈশিষ্ট্য:
একটি শক্তিশালী ও কার্যকর সংবিধানের জন্য নিম্নলিখিত বিষয়গুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ:
* গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের দৃঢ়তা: সংবিধানকে অবশ্যই একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থার নিশ্চয়তা দিতে হবে। জনগণের ভোটাধিকার এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে।
* মানবাধিকার ও মৌলিক অধিকারের সুরক্ষা: সকল নাগরিকের জন্য ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, জাতি নির্বিশেষে সমতা, ন্যায়বিচার এবং মানবাধিকারের পূর্ণাঙ্গ সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। বাক স্বাধীনতা, সমাবেশের স্বাধীনতা, চলাচলের স্বাধীনতা, এবং আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকতে হবে।
* আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা: সংবিধানের চোখে সকল নাগরিক সমান — এই নীতি নিশ্চিত করতে হবে। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের আইনের ঊর্ধ্বে না থাকার বিধান থাকতে হবে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি, যাতে তা নির্বাহী বিভাগের প্রভাবমুক্ত হয়ে কাজ করতে পারে।
* ক্ষমতা বিভাজন ও ভারসাম্য: রাষ্ট্রের তিনটি স্তম্ভ (আইনসভা, নির্বাহী বিভাগ, ও বিচার বিভাগ) এর মধ্যে ক্ষমতার সুস্পষ্ট বিভাজন এবং কার্যকর ভারসাম্য থাকা উচিত। কোনো একটি অঙ্গ যেন অন্যটির উপর অপ্রয়োজনীয় প্রভাব বিস্তার করতে না পারে, তার ব্যবস্থা থাকতে হবে।
* জনগণের সার্বভৌমত্ব: সংবিধানের সকল ক্ষমতার উৎস জনগণ—এই নীতিকে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরতে হবে। জনগণ যেন তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে।
* ধর্ম নিরপেক্ষতা: ধর্মকে রাজনীতির বাইরে রেখে রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমে সকল ধর্মের প্রতি সমান সম্মান প্রদর্শন করা উচিত। কোনো নির্দিষ্ট ধর্মকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা না দিয়ে সকল নাগরিকের ধর্মীয় স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দিতে হবে। (যদিও বাংলাদেশের সংবিধানের বর্তমান নীতি রাষ্ট্রধর্ম ইসলামকে অন্তর্ভুক্ত করেছে, তবে ধর্ম নিরপেক্ষতা একটি বিতর্কের বিষয়)।
* জাতীয়তাবাদ ও মুক্তি সংগ্রামের চেতনা: বাংলাদেশের অভ্যুদয় ও স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল চেতনা, অর্থাৎ বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র (শোষনমুক্ত সমাজ), এবং ধর্মনিরপেক্ষতাকে সংবিধানে প্রতিফলিত করা উচিত।
কার্যকরী সংবিধানের জন্য সুপারিশ:
একটি যুগোপযোগী সংবিধান প্রণয়ন বা সংস্কারের ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো বিবেচনা করা যেতে পারে:
* পরিবর্তনশীলতার সুযোগ: সংবিধান এমন হওয়া উচিত, যা সময় ও পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারে, তবে এর মৌলিক কাঠামো যেন অপরিবর্তিত থাকে। সংবিধান সংশোধনের প্রক্রিয়া যেন খুব সহজ বা খুব কঠিন না হয়, বরং একটি সুষম পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়।
* জরুরি অবস্থার বিধান: জরুরি অবস্থা ঘোষণার সুস্পষ্ট শর্তাবলী এবং এর সময়সীমা সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ থাকতে হবে, যাতে ক্ষমতার অপব্যবহারের সুযোগ না থাকে।
* স্থানীয় সরকার শক্তিশালীকরণ: স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও শক্তিশালী ও স্বায়ত্তশাসিত করার বিধান থাকতে হবে, যাতে তৃণমূল পর্যায়ে গণতন্ত্রের চর্চা হয় এবং জনগণের অংশগ্রহণ বাড়ে।
* পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন: বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে পরিবেশ সুরক্ষা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও নাগরিকের করণীয় সম্পর্কে সুস্পষ্ট নির্দেশনা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।
* ডিজিটাল নিরাপত্তা ও তথ্য অধিকার: ডিজিটাল যুগে নাগরিকদের তথ্য অধিকার এবং ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করার বিধান রাখা উচিত।
* নিরপেক্ষ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান: নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, এবং মহা হিসাব-নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক-এর মতো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ ও স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষমতা ও সুরক্ষা দিতে হবে।
বিতর্কের বিষয়:
বাংলাদেশের সংবিধানের আলোচনায় কিছু বিষয়ে বিতর্ক বিদ্যমান:
* রাষ্ট্রধর্ম বনাম ধর্মনিরপেক্ষতা: ১৯৭২ সালের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা থাকলেও, পরবর্তীতে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই দুটি নীতির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা বা যেকোনো একটিকে প্রাধান্য দেওয়া একটি বড় বিতর্কের বিষয়।
* সংসদীয় ও রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা: বর্তমানে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা প্রচলিত থাকলেও, অতীতে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের অভিজ্ঞতা রয়েছে। কোনটি দেশের জন্য বেশি উপযোগী, তা নিয়ে ভিন্নমত রয়েছে।
* তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা: নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হওয়ার পর থেকে এর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে বিতর্ক চলছে।
একটি সংবিধান কেবল একটি আইনি দলিল নয়, এটি একটি জাতির সম্মিলিত আকাঙ্ক্ষা ও মূল্যবোধের প্রতীক। বাংলাদেশের সংবিধান এমন হওয়া উচিত যা সকল নাগরিকের জন্য ন্যায়বিচার, সমতা ও উন্নতির পথ প্রশস্ত করে এবং একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করে।
আপনার কি সংবিধানের নির্দিষ্ট কোনো দিক সম্পর্কে জানতে আগ্রহ আছে?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *