বাংলাদেশে একটি উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন – ডক্টর এম এ মোশতাক


বাংলাদেশে একটি উন্নত ও কার্যকর চিকিৎসা ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য নিম্নলিখিত বিষয়গুলো বিবেচনা করা উচিত:
১. সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণ:
* সবার জন্য সহজলভ্য চিকিৎসা: ধনী-গরিব নির্বিশেষে সকল নাগরিকের জন্য মানসম্মত চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে হবে। এর জন্য স্বাস্থ্য বীমা ব্যবস্থার প্রসার এবং সরকারি স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নত করা জরুরি।
* প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার শক্তিশালীকরণ: কমিউনিটি ক্লিনিক ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোকে আরও কার্যকর ও শক্তিশালী করতে হবে, যাতে গ্রামীণ ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ সহজে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পেতে পারে।
২. মানসম্মত চিকিৎসা ও অবকাঠামো উন্নয়ন:
* হাসপাতালের সক্ষমতা বৃদ্ধি: সরকারি হাসপাতালগুলোতে শয্যা সংখ্যা বৃদ্ধি, আধুনিক যন্ত্রপাতি সরবরাহ এবং সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে।
* বিশেষায়িত চিকিৎসার প্রসার: ক্যান্সার, হৃদরোগ, কিডনি, লিভার, নিউরো, চক্ষু ইত্যাদি ব্যয়বহুল বিশেষায়িত চিকিৎসার সুযোগ সহজলভ্য করতে হবে এবং এর জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নিশ্চিত করতে হবে।
* গুণগত মান নিয়ন্ত্রণ: বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর সেবার মান কঠোরভাবে তদারকি করতে হবে এবং অনিয়ম রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
৩. দক্ষ জনবল তৈরি ও তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি:
* চিকিৎসক, নার্স ও টেকনিশিয়ানের অভাব পূরণ: জনসংখ্যার অনুপাতে পর্যাপ্ত সংখ্যক চিকিৎসক, নার্স, প্যারামেডিকস ও ল্যাব-টেকনিশিয়ান তৈরি করতে হবে এবং তাদের নিয়োগ প্রক্রিয়া বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে।
* প্রশিক্ষণ ও গবেষণা: চিকিৎসা শিক্ষাকে আধুনিক ও আন্তর্জাতিক মানের করতে হবে। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে এবং স্বাস্থ্য খাতে গবেষণাকে উৎসাহিত করতে হবে।
* কর্মস্থলে উপস্থিতি ও জবাবদিহিতা: চিকিৎসকদের কর্মস্থলে উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে, বিশেষ করে গ্রামীণ ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে। সকল স্বাস্থ্যকর্মীর মধ্যে পেশাদারিত্ব ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।
৪. স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বৃদ্ধি ও সুশাসন:
* পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ: জিডিপির আনুপাতিক হারে স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে, যা বর্তমানে অনেক নিম্নমধ্য আয়ের দেশের তুলনায় কম।
* অর্থের সঠিক ব্যবহার: বরাদ্দকৃত অর্থের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে এবং দুর্নীতি ও অপচয় রোধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
* নীতিমালা ও আইন সংস্কার: স্বাস্থ্য খাতের সংস্কারের জন্য প্রয়োজনীয় আইন ও নীতিমালা প্রণয়ন এবং বিদ্যমান আইনগুলোর সংস্কার করতে হবে। একটি স্বাধীন ও স্থায়ী ‘বাংলাদেশ স্বাস্থ্য কমিশন’ গঠন করা যেতে পারে।
৫. প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যসেবা ও জনসচেতনতা:
* রোগ প্রতিরোধে জোর: চিকিৎসার পাশাপাশি রোগ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার উপর জোর দিতে হবে। স্বাস্থ্য সচেতনতামূলক কর্মসূচি, স্যানিটেশন ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং নিরাপদ পানীয় জলের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।
* পুষ্টি ও স্বাস্থ্যসম্মত জীবনধারা: জনগণের মধ্যে পুষ্টিকর খাদ্যাভ্যাস ও স্বাস্থ্যসম্মত জীবনধারা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
* মানসিক স্বাস্থ্য: শারীরিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে হবে এবং মানসিক স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ বৃদ্ধি করতে হবে।
৬. প্রযুক্তির ব্যবহার ও ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা:
* টেলিমেডিসিন ও রিমোট কেয়ার: ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার করে টেলিমেডিসিন ও রিমোট কেয়ারের প্রসার ঘটাতে হবে, যাতে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ পেতে পারে।
* কেন্দ্রীয় তথ্যভান্ডার: রোগীর চিকিৎসা-সংশ্লিষ্ট সকল তথ্য নিয়ে একটি কেন্দ্রীয় তথ্যভান্ডার তৈরি করা প্রয়োজন, যা স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নয়নে সহায়ক হবে।
৭. ওষুধ শিল্পের উন্নয়ন ও সরবরাহ:
* কাঁচামাল উৎপাদন: ওষুধের কাঁচামাল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের দিকে নজর দিতে হবে, যাতে কম মূল্যে ওষুধ উৎপাদন ও রপ্তানি করা যায়।
* জরুরি ওষুধ সরবরাহ: দেশের প্রতিটি অঞ্চলে জরুরি ওষুধের পর্যাপ্ত ও নিয়মিত সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।
এই পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি শক্তিশালী, জনমুখী এবং টেকসই চিকিৎসা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারবে, যা দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *