বিদ্যুৎ সমস্যা বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং জটিল চ্যালেঞ্জ। এই সমস্যা সমাধানে রাষ্ট্রের বহুমুখী এবং সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। নিচে বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানে রাষ্ট্রের করণীয় বিষয়গুলো উল্লেখ করা হলো:১. উৎপাদন বৃদ্ধি এবং জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ
* জ্বালানি উৎসের বৈচিত্র্যকরণ: বিদ্যুৎ উৎপাদনে কেবল গ্যাস বা কয়লার ওপর নির্ভরশীল না হয়ে সৌর, বায়ু, জলবিদ্যুৎ, পারমাণবিক শক্তি এবং বায়োমাস-এর মতো নবায়নযোগ্য ও বিকল্প জ্বালানি উৎসের ব্যবহার বাড়ানো। এতে কোনো একটি উৎসের সংকটে সামগ্রিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রভাব কমবে।
* গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন: নিজস্ব গ্যাস ক্ষেত্রগুলোর অনুসন্ধান ও উত্তোলন কার্যক্রম জোরদার করা। নতুন গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কার এবং বিদ্যমান ক্ষেত্রগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানো গেলে গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো নিয়মিত চলতে পারবে।
* কয়লা নির্ভরতা হ্রাস ও আধুনিকায়ন: বর্তমানে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তবে, পরিবেশগত দিক বিবেচনা করে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন এবং পরিবেশবান্ধব (যেমন: আল্ট্রা-সুপারক্রিটিক্যাল টেকনোলজি) কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা যেতে পারে, এবং ধীরে ধীরে কয়লার ওপর নির্ভরতা কমানোর পরিকল্পনা থাকা উচিত।
* পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের সম্প্রসারণ: রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ দ্রুত সম্পন্ন করা এবং ভবিষ্যতে আরও পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা হাতে নেওয়া। এটি একটি স্থিতিশীল এবং বৃহৎ বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারে।
* আমদানি নির্ভরতা কমানো: দীর্ঘমেয়াদে আমদানি করা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (LNG) বা বিদ্যুতের ওপর নির্ভরতা কমানোর চেষ্টা করা, যদিও স্বল্পমেয়াদে এটি জরুরি হতে পারে।
২. সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ
* গ্রিড আধুনিকীকরণ ও স্মার্ট গ্রিড স্থাপন: পুরোনো এবং দুর্বল সঞ্চালন লাইন ও উপকেন্দরগুলো আধুনিকীকরণ করা। স্মার্ট গ্রিড প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ চুরি, সিস্টেম লস কমানো এবং বিদ্যুতের সরবরাহ ব্যবস্থাকে আরও দক্ষ ও নির্ভরযোগ্য করা।
* সিস্টেম লস কমানো: বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলোর সিস্টেম লস (বিদ্যুৎ চুরি ও কারিগরি ত্রুটির কারণে অপচয়) কমানোর জন্য কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। এক্ষেত্রে ডিজিটাল মিটার স্থাপন, নিয়মিত মনিটরিং এবং চোরদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।
* ভূগর্ভস্থ ক্যাবল স্থাপন: শহরের গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় বিদ্যুতের তার ভূগর্ভস্থ করার কাজ দ্রুত সম্পন্ন করা। এতে প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে যাওয়ার ঝুঁকি কমবে এবং বিদ্যুতের সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন থাকবে।
* দূরত্বভিত্তিক সঞ্চালন লাইন: বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র থেকে বিতরণ কেন্দ্র পর্যন্ত উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন সঞ্চালন লাইন স্থাপন করা, যা দীর্ঘ দূরত্বে বিদ্যুৎ পরিবহনে সহায়তা করবে এবং বিদ্যুতের অপচয় কমাবে।
৩. বিদ্যুতের দক্ষ ব্যবহার ও জনসচেতনতা বৃদ্ধি
* বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী যন্ত্রপাতির ব্যবহার উৎসাহিত করা: সরকার কর্তৃক বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী যন্ত্রপাতি (যেমন: এলইডি লাইট, ইনভার্টার এসি, রেফ্রিজারেটর) ব্যবহারে ভর্তুকি প্রদান বা কর মওকুফের ব্যবস্থা করা।
* জাতীয় সচেতনতা অভিযান: বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের গুরুত্ব সম্পর্কে জনগণের মধ্যে ব্যাপক সচেতনতা তৈরি করা। বিদ্যুৎ অপচয় রোধে বিভিন্ন গণমাধ্যম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সামাজিক সংগঠনের মাধ্যমে প্রচার চালানো।
* শিল্প ও বাণিজ্যিক খাতে দক্ষ ব্যবহার: শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী যন্ত্রপাতি ও পদ্ধতি ব্যবহারের জন্য উৎসাহিত করা। প্রয়োজনে প্রণোদনা এবং তদারকির ব্যবস্থা করা।
৪. প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি ও আর্থিক স্থিতিশীলতা
* দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি: বিদ্যুৎ খাতের গবেষণা, উন্নয়ন, পরিচালনা এবং রক্ষণাবেক্ষণের জন্য দক্ষ প্রকৌশলী ও কারিগরি জনবল তৈরি করা।
* দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা প্রণয়ন: বিদ্যুৎ খাতের জন্য একটি সুদূরপ্রসারী এবং বাস্তবসম্মত মহাপরিকল্পনা তৈরি করা, যা ভবিষ্যৎ চাহিদা পূরণে সক্ষম হবে।
* জ্বালানি মূল্যের সমন্বয়: বিশ্ববাজারে জ্বালানির মূল্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দেশের বিদ্যুতের মূল্য নির্ধারণে একটি যুক্তিসঙ্গত ও পর্যায়ক্রমিক পদ্ধতি অবলম্বন করা, যাতে বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোর আর্থিক সক্ষমতা বজায় থাকে এবং তারা বিনিয়োগ করতে পারে।
* অনুদান ও ভর্তুকি: নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্পগুলোতে বিনিয়োগ আকর্ষণ করার জন্য সরকার কর্তৃক আর্থিক অনুদান, ভর্তুকি এবং সহজ শর্তে ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করা।
৫. নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রসার
* সৌর বিদ্যুতের সম্প্রসারণ: বাড়ির ছাদে (রূফটপ সোলার), ভাসমান সোলার প্রকল্প এবং সোলার পার্ক স্থাপনের মাধ্যমে সৌর বিদ্যুতের উৎপাদন বৃদ্ধি করা। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে উৎসাহিত করার জন্য নীতি সহায়তা দেওয়া।
* বায়ু বিদ্যুতের সম্ভাবনা কাজে লাগানো: উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে বায়ু বিদ্যুতের সম্ভাবনা যাচাই করে বৃহৎ আকারের বায়ু বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপন করা।
* জলবিদ্যুৎ ও বায়োমাস: বিদ্যমান জলবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোর সংস্কার এবং নতুন ছোট আকারের জলবিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা। কৃষি বর্জ্য ব্যবহার করে বায়োমাস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্যোগ নেওয়া।
বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানে রাষ্ট্রকে একটি সমন্বিত মহাপরিকল্পনা নিয়ে এগোতে হবে, যেখানে স্বল্পমেয়াদী জরুরি পদক্ষেপের পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদী টেকসই সমাধানগুলোও অন্তর্ভুক্ত থাকবে। একইসাথে, এই খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।
