যানজট নিরসনে সরকারের করণীয় – ডক্টর এম এ মোশতাক


বাংলাদেশে যানজট নিরসন একটি জটিল এবং বহুমাত্রিক সমস্যা, যার সমাধানে সরকারের বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। এর মধ্যে স্বল্পমেয়াদী এবং দীর্ঘমেয়াদী উভয় প্রকারের পরিকল্পনা অন্তর্ভুক্ত থাকা উচিত।
নিচে সরকারের করণীয় বিষয়গুলো তুলে ধরা হলো:
১. গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ:
* মেট্রোরেল ও বিআরটি (BRT) প্রকল্পের দ্রুত বাস্তবায়ন: মেট্রোরেল এবং বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (BRT) প্রকল্পগুলো যানজট নিরসনে অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। এই প্রকল্পগুলো সময়মতো এবং দ্রুততার সাথে সম্পন্ন করা উচিত।
* আধুনিক ও পর্যাপ্ত বাস সার্ভিস: পুরোনো, লক্কর-ঝক্কর বাস বাদ দিয়ে আধুনিক, আরামদায়ক ও পর্যাপ্ত সংখ্যক বাসের ব্যবস্থা করা। রুটের সুবিন্যাস এবং বাস স্টপেজের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা। একইসাথে, গণপরিবহন ব্যবস্থায় একক টিকিট ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে, যাতে যাত্রীরা এক টিকিটে একাধিক পরিবহন ব্যবহার করতে পারেন।
* ওয়াটারওয়ে ও রেলওয়ের সম্প্রসারণ: ঢাকার চারপাশে এবং দেশের অন্যান্য অংশে জলপথ ও রেলপথের ব্যবহার বৃদ্ধি করা। এতে সড়কের ওপর চাপ কমবে।
২. স্মার্ট ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ও প্রযুক্তির ব্যবহার:
* স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যাল সিস্টেম: আধুনিক স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যাল ব্যবস্থা চালু করা, যা যানবাহনের চাপ অনুযায়ী স্বয়ংক্রিয়ভাবে সময় নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।
* সিসিটিভি ও নজরদারি: গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলোতে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করে ট্রাফিক আইন লঙ্ঘনকারীদের চিহ্নিত করা এবং শাস্তির আওতায় আনা।
* রিয়েল-টাইম ট্রাফিক আপডেট: জিপিএস ভিত্তিক রিয়েল-টাইম ট্রাফিক আপডেট প্রদান করা, যাতে চালকরা যানজট এড়িয়ে বিকল্প পথ বেছে নিতে পারেন।
* সমন্বিত ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র: একটি কেন্দ্রীয় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র স্থাপন করা, যা পুরো শহরের ট্রাফিক প্রবাহ পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ করবে।
* ইলেকট্রনিক রোড প্রাইসিং (ERP): যানজটপ্রবণ এলাকায় ব্যক্তিগত গাড়ির প্রবেশ নিয়ন্ত্রণে ইলেকট্রনিক রোড প্রাইসিং (ERP) এর মতো পদ্ধতি চালু করা যেতে পারে।
৩. সড়ক অবকাঠামোর উন্নয়ন ও পুনর্গঠন:
* রাস্তা প্রশস্তকরণ ও নতুন সড়ক নির্মাণ: প্রয়োজনে রাস্তা প্রশস্ত করা এবং নতুন বাইপাস, আন্ডারপাস, ফ্লাইওভার ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করা। ঢাকার জন্য তিনটি রিং রোড এবং নতুন ১২০০ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে, যা দ্রুত বাস্তবায়ন করা উচিত।
* অবৈধ পার্কিং ও রাস্তা দখলমুক্ত করা: রাস্তার উপর ও ফুটপাতে অবৈধ পার্কিং এবং স্থাপনা সরিয়ে পথচারী ও যানবাহনের জন্য পর্যাপ্ত স্থান নিশ্চিত করা।
* সড়ক মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ: নিয়মিত সড়ক মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ করা যাতে খানাখন্দের কারণে যানজট সৃষ্টি না হয়।
* সাইকেল লেন ও পথচারী ফুটপাত: শহরের ভেতরে সাইকেল লেন এবং প্রশস্ত পথচারী ফুটপাত তৈরি করা, যাতে মানুষ হেঁটে বা সাইকেলে যাতায়াতে উৎসাহিত হয়।
৪. ট্রাফিক আইন প্রয়োগ ও জনসচেতনতা বৃদ্ধি:
* কঠোর আইন প্রয়োগ: ট্রাফিক আইন লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা। কোনো প্রকার রাজনৈতিক প্রভাব বা অনৈতিক সুবিধা ছাড়াই আইন প্রয়োগে কঠোর হওয়া।
* ট্রাফিক পুলিশের সক্ষমতা বৃদ্ধি: ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের আধুনিক প্রশিক্ষণ ও সরঞ্জাম দিয়ে সজ্জিত করা এবং তাদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা।
* জনসচেতনতা বৃদ্ধি: সাধারণ মানুষকে ট্রাফিক আইন মেনে চলতে, যত্রতত্র রাস্তা পারাপার না করতে এবং গণপরিবহন ব্যবহারে উৎসাহিত করতে ব্যাপক সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালানো।
* অবৈধ যানবাহনের বিরুদ্ধে অভিযান: অবৈধ রিকশা, ব্যাটারিচালিত রিকশা এবং অন্যান্য অবৈধ যানবাহনের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান চালানো এবং প্রধান সড়ক থেকে সেগুলো অপসারণ করা।
৫. দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ও বিকেন্দ্রীকরণ:
* পরিকল্পিত নগরায়ণ: অপরিকল্পিত নগরায়ন বন্ধ করে আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকার সঠিক পরিকল্পনা করা, যাতে যানবাহনের চাপ সুষমভাবে বন্টিত হয়।
* সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বিকেন্দ্রীকরণ: ঢাকাকেন্দ্রিকতা কমাতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল ও শিল্প কারখানা স্থাপন করা। এতে ঢাকার উপর জনসংখ্যার চাপ কমবে।
* শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সময়সূচি: স্কুল-কলেজের ছুটির সময়সূচি পুনর্বিন্যাস করে যানজট কমানোর চেষ্টা করা।
* শহরগুলোতে পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করা: ঢাকার বাইরে অন্যান্য জেলা শহরগুলোতে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান ইত্যাদি ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করলে মানুষের ঢাকায় আসার প্রবণতা কমবে।
যানজট নিরসনে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপগুলোর মধ্যে মেট্রোরেল, ফ্লাইওভার নির্মাণ, সড়ক প্রশস্তকরণ, ইউ-লুপ তৈরি, এবং আধুনিক ট্রাফিক সিগন্যাল ব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ উল্লেখযোগ্য। তবে, এই সমস্যা সমাধানে একটি সমন্বিত এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করে তার ধারাবাহিক বাস্তবায়ন অপরিহার্য। পাশাপাশি, জনগণের সচেতনতা ও সহযোগিতা এই প্রক্রিয়াকে আরও ফলপ্রসূ করবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *