বৃটিশ রাজতন্ত্রের ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম হলো মহারাণী ভিক্টোরিয়া। অনেক রাজা-রাণীই এসেছেন গিয়েছেন, কিন্তু কতজনের নামই বা সবার মনে আছে? কিন্তু রাণী ভিক্টোরিয়া হলেন তাদের থেকে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী একজন। ইতিহাসের দ্বিতীয় দীর্ঘতম শাসনকর্তা হিসাবে রাণী ভিক্টোরিয়ার নাম বৃটিশ রাজতন্ত্র তথা পৃথিবীর ইতিহাসে জ্বলজ্বল।
তাঁর শাসনকালের সময়কাল এতটাই বিখ্যাত হয়ে আছে যে, কেবল বৃটিশ রাজতন্ত্রের ইতিহাসেই নয় বরং পৃথিবীর ইতিহাসের ঐ সময়টাকে ইংরেজীতে বলা হয়ে থাকে ‘Victorian era’, আবার ঐ সময়কালের স্থাপত্যকলা, কারুকার্য, ডিজাইন ইত্যাদিকে বলা হয় ‘Victorian design’. সেই মহারাণী ভিক্টোরিয়ার জীবনের খুব বেশী কাছের এবং তাঁর সাথে খুবই অন্তরঙ্গ সম্পর্কের এক পুরুষ হলেন ভারতীয় এক যুবক, যার নাম মুন্সী আব্দুল করিম।
অনেকেই হয়তো রাণী ভিক্টোরিয়া আর মুন্সী আব্দুল করিম সম্পর্কে অবগত আছেন, আবার অনেকের কাছেই হয়তো মুন্সী আব্দুল করিমের নামটি সম্পূর্ণ অজানা। রাণী ভিক্টোরিয়ার জন্ম ১৮১৯ সালের ২৪ মে লন্ডনের কেনসিংটন প্রাসাদে। পুরো নাম আলেকজান্দ্রিনা ভিক্টোরিয়া। তাঁর মা সোহাগ করে ডাকতেন দ্রিনা। তিনি ছিলেন ডিউক অব কেন্ট, প্রিন্স অ্যাডওয়ার্ডের একমাত্র সন্তান। অ্যাডওয়ার্ড ছিলেন রাজা তৃতীয় জর্জের চতুর্থ পুত্র।
১৮২০ সালে ভিক্টোরিয়ার বয়স যখন একবছরও পূর্ণ হয়নি তখন বাবা অ্যাডওয়ার্ড মারা যান। এরপর শুধু মায়ের আদরেই বেড়ে উঠেন ভিক্টোরিয়া। তিনি কখনো স্কুলে যাননি; কিন্তু তার জন্য একজন জার্মান গৃহশিক্ষিকা রাখা হয়েছিল। ছোট থেকেই জার্মান ও ইংরেজি দু’ভাষাতেই পারদর্শী হয়ে ওঠেন তিনি।
ভিক্টোরিয়াকে কখনোই একা থাকতে হয়নি। কিন্তু তবুও তিনি ছিলেন একা। সমবয়সী কারো সঙ্গে মেশার সুযোগ তার কখনো হয়নি। প্রাসাদে কঠোর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে বেড়ে ওঠা রাণীর একান্ত সময় বলে কিছুই ছিলনা।
রানী ভিক্টোরিয়ার পিতা প্রিন্স এডওয়ার্ডের বড় তিন ভাই যখন পরলোক গমন করেন তখন তাদের কোন বৈধ সন্তানাদি ছিলোনা, আর সেজন্যই ভিক্টোরিয়া ১৯৩৭ সালে মাত্র আঠারো বছর বয়সে বৃটিশ রাজসিংহাসনে আরোহন করেন।
কে এই আব্দুল করিম?
মুহাম্মদ আবদুল করিমের জন্ম ১৮৬৩ সালে ভারতবর্ষের উত্তর প্রদেশের ললিতপুর নামক জায়গায়। তিনি ছিলেন ছয় সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয়; এক বড় ভাই এবং চার ছোট বোন। তার বাবা ব্রিটিশ অশ্বারোহী রেজিমেন্ট হাসপাতালের সহকারী হিসাবে কাজ করতেন। বড় হয়ে আব্দুল করিম কাজ নিলেন আগ্রা জেলের একজন কেরানী হিসেবে। জেলের পরিদর্শক জন টাইলারের সাথে আব্দুল করিমের বেশ ভালো সম্পর্ক ছিলো।
রানী ভিক্টোরিয়ার ব্রিটেনের রাজসিংহাসনে আরোহণের পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে ভারতবর্ষ থেকে দুজন কর্মচারীকে নিয়োগ দেবার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সেই দুজনকে বাছাই করার দায়িত্ব দেওয়া হয় জেল পরিদর্শক জন টাইলারকে। জন টাইলার বাছাই করেন আব্দুল করিম আর মোহাম্মদ বকশ নামক দুজনকে।
সময়টা ছিল ১৮৮৭ সাল। সমগ্র ভারতের পক্ষ থেকে রাণী ভিক্টোরিয়ার সিংহাসনে আরোহনের স্বর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে তাঁর হাতে তুলে দেয়া হবে একখানা মোহর। মোহরটি রাণীর হাতে তুলে দিবে দু’জন ভারতীয় কর্মচারী আর সে দুজন হলো আব্দুল করিম ও মুহাম্মদ বখশ। আব্দুল করিম দেখতে ছিলেন বেশ লম্বা আর সুদর্শন।
আবিদুল করিম রাণীকে প্রথমবারের মতো মুগ্ধ করেন তার হাতের রান্না দিয়ে।
করিমের হাতের পোলাও, ডাল আর চিকেন কারির স্বাদে মুগ্ধ হয়ে যান রাণী। রাণীর জীবনী রচয়িতা এ.এন. উইলসনের মতে, করিমের এই রান্না রাণীর এতটাই ভালো লেগেছিল যে এটিকে তিনি নিজের প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে নেন।
ধীরে ধীরে ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতি আরও বেশি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন রাণী। এরই ধারাবাহিকতায় করিমকে তিনি আদেশ দেন তাঁকে উর্দু ভাষা এবং পবিত্র কোরান শেখানোর জন্য। তিনি আব্দুল করিমকে উপাধি দেন ‘মুন্সী’, অর্থাৎ নিজের শিক্ষক হিসেবে। এভাবেই আব্দুল করিমের নাম হয়ে যায় মুন্সী আব্দুল করিম।
রাণী ভিক্টোরিয়া যেন আব্দুল করিমের মাঝে এক নিষ্পাপ প্রতিচ্ছবি খুঁজে পেলেন। রাণীর স্বামী আলবার্ট মারা গেছেন দীর্ঘদিন আগে। তারপর থেকেই তিনি একা। তাঁর চারপাশে ঘুরে বেড়াতো প্রধানমন্ত্রী, অভিজাত বংশের সন্তান, রাজকীয় কর্মচারীরা; কিন্তু সকলকেই তাঁর স্বার্থান্বেষী বলেই মনে হতো, তিনি বুঝতে পারতেন ক্ষমতা আর প্রতিপত্তির লোভে সবাই অন্ধ। কিন্তু ভারতের অধিবাসী আব্দুল করিম যেন তাদের চেয়ে ভিন্ন।
তাঁর সততা, চঞ্চলতা মুগ্ধ করতো রাণীকে। তিনি আব্দুল করিমকে নিজের সার্বক্ষণিক সঙ্গী করে নিলেন। তাঁর কাছে খুলে বলতে লাগলেন নিজের জমে থাকা কথাগুলো। বহুদিন পর এমন কাউকে পেলেন, যার কাছে প্রকাশ করা যায় মনের অনুভূতিগুলো। অপরদিকে আব্দুল করিম রাণীকে শোনালেন তাজমহল আর সম্রাট শাহজাহানের গল্প, দিল্লীর মোঘলদের প্রাসাদ আর রাস্তাঘাটের আভিজাত্যের গল্প, আর কত কি!
‘কমান্ডার অফ দ্য অর্ডার’ উপাধি
রানীর সফরগুলোতেও সঙ্গী হিসেবে থাকতেন আব্দুল করিম। রানীর নির্দেশেই বালমোরাল ক্যাসেলের পাশে তার জন্য নির্মাণ করা হয় ‘করিম কটেজ’। সেই সুসজ্জিত কটেজেই বসবাস করতেন আব্দুল করিম। পাশাপাশি রানীর বিশেষ আদেশে তাকে ভারত বিষয়ক সচিব নিয়োগ দেওয়া হয়। তাই ভারত সংক্রান্ত রাজসিদ্ধান্ত নেওয়ার পূর্বে রানী ভিক্টোরিয়া তার পরামর্শ চাইতেন।
আব্দুল করিমকে সচিব নিয়োগ দেয়াকে কেন্দ্র করে রাজপরিবারের সদস্যদের মধ্যে চাপা অসন্তোষও ছিলো। সাধারণ এক ভারতীয় খিদমতগার থেকে রানীর পরামর্শক হয়ে উঠায় রাজপরিবারে অনেকের চক্ষুশুলে পরিণত হয়েছিলেন আব্দুল করিম। রাজপরিবারের অনেকের মতামত উপেক্ষা করে ১৮৯৯ সালে রানী ভিক্টোরিয়ার ৮০তম জন্মদিন উপলক্ষ্যে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে মুন্সি আব্দুল করিমকে রাণী ‘Commander of the Order (CVO)‘ উপাধিতে ভূষিত করেন।
উল্লেখ্য যে কমান্ডারদের সম্মানের অবস্থান মূলত নাইট উপাধিধারীদের পরেই। ‘কমান্ডার অফ দ্য অর্ডার’ হিসেবে নিযুক্ত হওয়ার ফলে আব্দুল করিম রানীর দেয়া তলোয়ার বহন করার অনুমতি পেয়েছিলেন। সেই সাথে রাজদরবার এবং প্রাসাদে রানীর স্বাক্ষরিত অনুমতিপত্র ছাড়াও দেখা করার অনুমতি লাভ করেন।
এদিকে বিচক্ষণ রানী আব্দুল করিমের উপর রাজপরিবারের সদস্যদের চাপা ক্ষোভের স্বরূপ ঠিকই অনুমান করতে পেরেছিলেন। তিনি বিলক্ষণ অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে তার মৃত্যুর পর আব্দুল করিমকে তার কটেজ থেকে বিতাড়িত করে ভারতে ফেরত পাঠানো হতে পারে। তাই তার জীবদ্দশাতেই ভারতে আব্দুল করিমের জন্যে জায়গা বরাদ্দ দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। পাশাপাশি রাণীর আদেশ ছিলো আব্দুল করিম যদি ব্রিটেন থেকে ভারতে ফিরে যান, তাহলে তার মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত বড়লাট তাকে প্রতিবছর ছয় শত রুপি হারে ভাতা দিতে বাধ্য থাকবে।
কিন্তু পড়ন্ত বয়সে এসে রাণীর এমন আচার আচরণ সহ্য হচ্ছিল না রাজবংশের সদস্য, কর্মচারীদের। ভারত থেকে আসা এক সামান্য কেরানি কিনা দখল করে নিচ্ছে রাণীর প্রিয়পাত্রের স্থান। তারা একের পর এক বানানো অভিযোগে কান ভারী করতে লাগল রাণীর। কিন্তু এতোদিন পর পাওয়া মনের মতো নিঃস্বার্থ বন্ধুকে ছাড়তে চাইলেন না রাণী ভিক্টোরিয়া। শত মান-অভিমান সত্ত্বেও ধরে রাখলেন আব্দুল করিমকে। একেবারে মৃত্যুশয্যা পর্যন্ত।
রাণী ভিক্টোরিয়া পরলোক গমন করেন ১৯০১ সালে। তখন সিংহাসনে বসেন তাঁর পুত্র প্লেবয় স্বভাবের অধিকারী রাজা সপ্তম এডওয়ার্ড। মুন্সী আব্দুল করিমের প্রতি চেপে রাখা ক্ষোভ তখনো তার মনে প্রবল। তিনি প্রথমেই আদেশ করলেন আব্দুল করিমের সাথে রাণীর সংশ্লিষ্ট সবকিছু পুড়িয়ে ফেলতে। রাণীর উর্দু শিখার খাতা, করিমের উপহার দেয়া জিনিসপত্র, সবকিছু। আব্দুল করিমকে শুধূ অনুমতি দেয়া হয় রাণীর শেষকৃত্যে অংশগ্রহণের। ঐ বছরই আব্দুল করিমকে পাঠিয়ে দেয়া হয় ভারতে।
ভারতে এসে তিনি বসবাস করতে থাকেন সেই জায়গাতে যা রানী তাকে উপহার হিসেবে প্রদান করেছিলেন।
মুন্সী আব্দুল করিম পরলোক গমন করেন ১৯০৯ সালে, আর এভাবেই তিনি হারিয়ে যান ইতিহাসের পাতা থেকে।
করিমের প্রতি ঈর্ষার কারণ বোঝাতে ইতিহাসবিদ ক্যারলি এরিকসন তার ‘হার লিটল ম্যাজেস্টি’তে লিখেছিলেন, ‘একজন কালো গাত্রবর্ণ বিশিষ্ট ভারতীয় পরিচারক শ্বেতাঙ্গ পরিচারকদের মতোই সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে, এটা তারা কিছুতেই সহ্য করতে পারছিল না। রাণীর সাথে একই টেবিলে বসে খাওয়া, রাণীর ব্যক্তিগত সঙ্গী হয়ে ওঠা, এসবই তারা নিজেদের জন্য চূড়ান্ত অপমানজনক হিসেবে গণ্য করেছিল।’
এভাবে দীর্ঘকাল এ ইতিহাস চাপা পড়ে থাকে। রাণী ভিক্টোরিয়া আর মুন্সী আব্দুল করিমের সম্পর্কের কথা অনেকটাই হারিয়ে যায় ইতিহাসের পাতা থেকে। এরপর সর্বপ্রথম ২০১০ সালে রাজ পরিবার বিষয়টিকে সকলের সামনে নিয়ে আসে। রাণীর সাথে মুন্সী আব্দুল করিমের ফটোগ্রাফও প্রকাশ করা হয়। আব্দুল করিমকে নিয়ে আঁকা রাজকীয় ছবিও সবার গোচরে আসে।
এ কাহিনীকে উপজীব্য করে নির্মিত হয় ব্রিটিশ সিনেমা “Victoria and Abdul”.
বলা যায় এর মধ্য দিয়েই ইতিহাসের হারিয়ে যাওয়া একটি চমকপ্রদ অধ্যায় যেন আবার জীবন্ত হয়ে ফিরে আসে ইতিহাসপ্রিয়দের কাছে……
Saker
(Toronto, Canada)
———————————————-
Munshi Abdul Karim and Mohammed Buksh with Queen Victoria.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here