মানুষের অসুখ হলে সেটা শরীরে আগে থেকেই টের পাওয়া যায়। কিন্তু করোনার ভাইরাস কোথা থেকে কিভাবে,কোন সুত্রে আসবে সেটা জানা যায় না। যে কোন মুহূর্তে যে কোন ঊপায়ে ভাইরাস ডুকে পড়তে পারে শরীরে। তাই একটাই পথ সাবধানে থাকুন । কিন্তু কিভাবে ?
মাত্র ৩ মাস আগেও যে লং টার্ম হোমে কাজ করেছিলাম সেখানে ৫-৬ জন রোগী থাকেন, যারা হাত নেড়ে খেতে পারে না। ২৯ বছরের মেয়ে স্টেফি গত ২০ বছর ধরে হুইল চেয়ারে জীবন পার করছেন। স্টেফিকে মাত্র এক ঘণ্টা একা রাখা উচিত না, তাহলে স্টেফিকে কে দেখবে? কে যাবে ওকে ধরে ধরে সব কাজ করাতে? তার জীবন কি নিরাপদ, সে কি করে ঘরে থাকবে, তাহলে স্টেফিকে বাচাবে কে? এমন বিলিয়ন বিলিয়ন অবস্থা প্রতি সেকেন্ডে মোকাবেলা করেই করোনার শিকল পড়ে আছি আমরা অনেকেই । এটাই বাস্তবতা , এটাই জীবন।
এই মুহুরতের লেখার বিষয় আরো অনেক গভীর। আরো অনেক অনেক বেশী যন্ত্রনার। মানুষ মরে গেলে সব মিমাংসা শেষ। কিন্তু বেচে থাকা অব্ধি বা যে মুহূর্ত অব্ধি মানুষের শ্বাস আছে ততক্ষণ?
সব চিন্তা থাকে, অনুভুতি জুড়ে থাকে মন আর শরীর, বার বার মনে হয় আহহা এটাতো করতে পারলাম না জীবনে? তাহলে বেচে আছি কেন? এই অনুভুতি কিন্তু প্রতিটা মানুষের আছে, থাকতেই হবে। এর থেকে বের হওয়া যায় না। বের হতে পারছি না এই মুহুরতে।
৮৩ বছরের অসুস্থ্ বাবা পড়ে আছেন বিছানায় এ মুহুর্তে ঢাকায়, ধানমণ্ডির অতি পরিচিত বাসায়। যে চার কন্যা সন্তানকে জন্ম দিয়ে বাবা সারজীবন গরুর মুখে যেমন খাচা বা ঠুসি লাগানো থাকে, তেমনি বাবার জীবনে হয়তো একটা চাকরির ঠুসি লাগানো ছিলো আজন্ম।
অনেক কথা আসছে, পরিবারের মেয়েদের কাছে থেকে, অনেকের কাছে থেকে , ভালো মন্দ সব কথা সবাই চাপা স্বরে নিচু গলায় বলে চলছেন অনবরত। কিন্তু আমার এই শূন্য ঘরে, ভীষন একাকী নিঃসঙ্গ প্রবাস জীবনে বার বার নিজেকে প্রশ্ন করছি কেন বাবা চাকরি করতেন?
কেন বাবা সব ছেড়ে কাজ ভালোবেসেছিলেন? আর কি পথ খোলা ছিলো বাবার সামনে? বাবা কি কোনদিন নিজের মুখ থেকে ওই ঠুসি খোলার কথা ভেবেছিলেন?
এই করোনার কালে বাবাকে দেখতে অনেকে আসছেন। আমরা তো যেতে পারছি না। এই চার মেয়ে যাদের মুখে অল্প এক্টু ভাত আর একটা মাথা গোজার মাত্র একটা ঘর জোগাড় করতে আব্বার জীবন থেকে ৮৩ বছর পার হয়ে গেলো। আব্বা হয়তো কোনদিন ভাবেননি-এর চেয়ে ভালো আব্বা আমাদের রাখতে পারতেন কি না?
এর চেয়ে ভালো বাবা নিজেও থাকতে পারতেন কি না ? যেমন আমি ভাবতে পারি না- ঝুকি নিতে ভীষন ভয় পাই, বার বার মনে হয় এই তো ভালো আছি- তাই হয়তো আরো ভালো থাকা হয়নি বাবার মতো আমারও? টাকা, বাড়ি কিছুই হয়নি, শূন্য হাতেই –দেনা-পাওনা বিহীন এক অতি সাধারন জীবন।
বড় মামা বলতেন, শোন লুনা- টাকার জন্য লোভ না থাকলে টাকা বানানো যায় না। অনেক টাকা আছে তাই আমার বড়মামার, সেটা কি মামাকে সুখী করেছে? খুব গোপনে জানতে ইচ্ছে করে। যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে মামা ছোট একটা নামাজের পাটিকে আশ্রয় করলেন কেন গত ২০ বছর?
কেন বড়মামা ঢাকা শহরের বিভিন্ন কোনায় কোনায় তার যেসব এপার্টমেন্ট আছে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে পারছেন না? বা ওই যে দারুন জনপ্রিয় ইরফান খান- মাত্র ৩৬০ কোটি টাকা রেখে গেছেন, তিনি-ই বা কেন টাকা আর ক্ষমতা দিয়ে মৃত্যু আটকে দিতে পারলেন না?
ঢাকা থেকে গত ৪ দিন আম্মা ভিডিও পাঠাচ্ছেন, আব্বার বর্তমান অবস্থার ভিডিও। কখনো আব্বা নাস্তা করছেন, কখনো বাথরুমে যাচ্ছেন, বা কখনো কেউ আব্বার সাথে কথা বলছেন, আম্মা সেইসব ভিডিও পাঠাচ্ছেন আমাদের চারবোনকে।
অসহায় আমরা, অনেক অনেক কষ্টের অপেক্ষার আর বিনিদ্র রজনীর স্বপ্নের সেই আমেরিকা-কানাডার কাগজ আছে চারবোনের হাতেই। সময় আছে, প্লেন ধরার মতো অবস্থাও আছে- কিন্তু করোনা বন্ধ করেছে সব চলাচল। সারা বিশ্বের মানুষ এক অদৃশ্য শিকলে বন্ধী। এটা কোভিড কাল তোমার হাতে কিছুই নেই অপেক্ষা করা ছাড়া।
কি নিয়ে অপেক্ষা করে আছি আমরা চারবোন? আমিই কি কেবল অন-লাইন অফিসের সময় ফাকি দিয়ে বাবাকে ভাবছি? কেবল মন চলে যাচ্ছে বাবার গোটা জীবনের দিকে? কি করে পাড় করলেন বাবা এই দীর্ঘজীবন? মনে করার আপ্রান চেস্টা করছি বাবা আর কি কি ভালোবেসেছিলেন নিজের নিত্যদিনের কাজ ছাড়া? আর কি –ই বা করতে পারতেন এই জীবন জুড়ে ?
সত্যটা কি জানেন পাঠক, বাবার ওরসে আমরা জন্ম নিয়েছিলাম মেয়ে হিসেবেই। বাবাও আমাদের মেয়ে হিসেবেই দেখতেন। পৃথিবী জয় করে , আমেরিকা /কানাডায় নিজেদের মতো করে জীবন চালাবো এমন স্বপ্ন বাবা যে অন্তত কোনদিন দেখেন-নি সেটা আর কেউ না জানুক, আমরা জানি বা বিশেষ করে আমি তো বিস্বাশ করি মনে প্রানে।
তবুও এই কয়েকবছর আগে আব্বা নাকি একদিন অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে কাকে যেন বলেছেন, “আমার চার মেয়ে আছে , আমার জন্য ভাবনার দরকার নেই তোমাদের?”
জীবনের শেষ বছরগুলোতে কি বাবা ভীষন গৌরব আর অহংকার পুষে রাখতেন আমাদের জন্য? জানা তো হলো না সেই কথা । এমন কত কত প্রশ্ন , ইচ্ছে , কথা বাবাকে ঘিরে মন আচ্ছন্ন হয়ে আছে ।
বেশ কিছু খাড়া পথ পাড় হতে হয়েছে, মনে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃবিজ্ঞান বিভাগে চান্স পাবার সাথে সাথে আরো ৪ টা বিভাগে চান্স পেয়েছিলাম, সাভারের পিএটিসির বাসায় এক অপরূপ বিকেলে অফিস ফেরতা বাবার সাথে আসলেন এক ত্রুণ অফিসার। নাম সুপথ কুমার ঘোষ। বাবা বললেন, না লুনা , ভুগোল বিভাগেই ভর্তি হোক অন্তত কলেজ টিচার তো হতে পারবে।
সুপথ আঙ্কেল বাধ সাধলেন, ঘাড় নিচু করে মাথা চুলকে চুলকে বাবাকে বললেন, না স্যার আমার কথাটা রাখেন স্যার। বাংলাদেশে নৃবিজ্ঞান নতুন সাবজেক্ট , এখানে অনেক অনেক বেশী সম্ভবনা, লুনাকে এই সাবজেক্টেই ভর্তি করান স্যার দেখবেন অনেক অনেক জব আসবে সামনে।
আজন্ম ঝুকি নিতে না পারা , গড়পড়তা নিন্ম মধবিত্ত বাবা – একটা বক্স থেকে বের হলেন সেই বিকেলে , হাটা শুরু করলাম অজানা পথে – জীবনের এই অপার নতুন পথের যাত্রার জন্য কার কাছে ঋণ স্বীকার করবো আমি বাবা নাকি সুপথ আঙ্কেল ?
বিয়ে করেছিলাম নিজের ইচ্ছাতেই , বাবা বাধা দেননি, হয়তো ভেবেছেন, লুনার মতো মিছিল /মিটিং করা , ঢাকা শহর চষে বেড়ানোর মেয়ের জন্য বাবা কি পাত্র ঠিক করবেন ?
কিন্তু আজকে মনে পড়ছে বাবা,র সেই মুখ – যেদিন আমি সম্পর্ক ছিন্ন করতে যাবো – দপুরে বাবা এক্টু কোরান পাঠ করছিলেন – আগে থেকেই সব প্রস্তুত করা ছিলো – যেহেতু নাইয়ার বাবা আর আমি মিঊচুয়াল ডিভোর্স করেছি তাই আজ ১৯ বছরেও কোন অনুতাপ বা ক্ষেদ নেই – তবুও সেই বিকেলে বাবার কাছে গেলাম, বাবা কোরান পাঠ শেষ এক্টু দোয়া করতে বসবেন হয়তো – বাবাকে জানালাম- বললাম – “আব্বা আমি এই কাজে যাচ্ছি, আজ ফাইনাল কাজ শেষ করে ফিরবো , বাবা কি একবার আমার মুখের দিকে তাকালেন ?
বাবা কি এক মুহুরতের জন্য ভাবলেন – মেজো মেয়ে লুনা, যার কোলে মাত্র ১১ মাসের শিশু সন্তান – সে কি পারবে এই পথে একলা হাঁটতে ? তবুও বাবা খুব নীরব স্বরে জানতে চাইলেন –তুমি ভালো করে চিন্তা করছো তো ? বললাম – হ্যা আব্বা তুমি ভেবো না – আমার জন্য দোয়া করো ।আব্বা আবার কোরান তা টেনে নিলেন হাতে । সেই নৃবিজ্ঞান বিভাগের মতোই আব্বা,র সাথে কথা বলেই একটা নতুন জীবন শুরু হলো ৩০ বছর বয়সে – আমিও গ্রুর মতই , বা অনেকটা বাবার মতই নিজের মুখের সাথে পড়িয়ে নিলাম ঠুসি – অদৃশ্য ঠুসি – একলা চলার খাচা ?
আব্বা কি ভীষন একলা ছিলেন ?? আমার বাকী বোনেদের ভাষায় বা অনেকটা আমার মায়ের ভাষাতেও আব্বার নাকি কোন গভীর বোধ ছিলো না- আব্বার নাকি গভীর অনুভুতি ছিলো না – আসলে কি মনে হয় জানেন – যেসব মানুষের ঘাড়ে – সন্তানদের দায় , বাসা ভাড়া, টেবিলে ভাত যোগাড় করা, বা মাসকাবারি বেতনের চিন্তা থাকে, বেতন উপরে জীবন চলে — এইসব ভাবনা বা গভীর বোধ তাদের না থাকাই ভালো – এইসব বোধ /ফোদ তো কষ্ট ছাড়া কিছু দেয় না শেষ অর্থে– তাই না ?
এই যে এত সব গভীরতা দিয়ে ২০ বছরের ছেলে নাইয়ে কে বড় করলাম , কি এমন দশদিক ঊদ্ধার করলাম ? নাকি বোধহীন যে বাবা ৮৩ বছর গরুর ঠুসি মুখে দিয়ে আমাদের ভাত কাপড় দিয়েছেন , তার শেষ সময়ে আমরা কি দৌড়ে যেতে পারছি ? জীবনে সঠিক সময়ে কিছু করা বা সঠিক প্রাপ্তি যে একাবারেই হয় না , হতে দেয় না জীবন এটা বুঝতে অনেকটা সময় গড়িয়ে যায় – অনেকে-র গেছে , আরো যাবে- ।
আর কয়টা দিন সময় আছে আব্বার হাতে ? হয়তো অল্প কয়েকটা দিন বা হয়তো বেশ কিছু বছর – কিছুই জানি না , কান্নাও আসছে না এই মুহূর্তে , শেষ করবো লেখা , কি বলবো নিজেকে ? আব্বা কষ্ট না পাক, আব্বা কষ্ট না পাক, আব্বা যন্ত্রনা না পাক- এই ছাড়া আর তো কিছু আসছে না মাথায় , অন্য কোন কাজে মন ও বসে না, কেমন নিঃস্প্রান লাগছে চারপাশ ।
এই তো ২০১৯ এ মার্চ মাসে আব্বার মাথায় হাত রেখেছিলাম আমরা চারবোন -ধানমণ্ডির বাসা ছাড়ার আগে- মধ্যরাত তখন , বাবা বিছানাতেই ছিলেন- তার কয়েক দিন আগেই আব্বা বলেছিলেন – তিনি তার চার-মেয়েকে দেখেছেন – তিনি চলে গেলে আমরা যেনো দেশে ফেরার জন্য তাড়া না করি – খুব অল্প সময়ের ভিতরেই যেনো তাকে মাটিতে শুইয়ে দেয়া হয় – এই কোভিড কি বাবার শেষ কথা পালনের জন্যই পথ রোধ করে দাড়ালো ? আল্লাহ , তুমি আমার বাবার ব্যাথা কমিয়ে দিও খোদা , আমার বাবার যন্ত্রনা কমায়ে দাও আল্লাহ ।