(উৎসর্গঃ আমার প্রিয় বন্ধু কবীর কে )
রচনা কালঃ ১৪/০৫/২০১৭, ম্যানচেস্টার, যুক্তরাজ্য)

তোমাদের আমি চিরচেনা সে-ই চিঠি – কাগজের চিঠি,
সাদা কাগজে কালোর আঁখরে বোনা ভাবের লুটোপুটি।

বল্‌ পয়েন্ট্‌ পেন আর পার্কারের নিবের আঁচড় খেয়েছি বহু,
তবুও আর্তনাদ কিম্বা অভিযোগ করিনি কভু;

কত লেখনীর কৃষ্ণ কান্নায় সিক্ত হয়েছি আমি কে জানে!
কত প্রেম,
কত ভালোবাসা,
কত দুঃখ,
কত যাতনা,
কত দীর্ঘশ্বাস,
কত চাওয়া,
কত না পাওয়া,
কত ভুল বুঝাবুঝি,
কত সুখ বারতার বোঝা বয়েছি আমি কোন আর্কাইভ কি তা জানে?

একদিন দেখি,
দীঘির ঘাটে কাপড় কাচার ছলে বেহুদা করছে সময় ক্ষেপণ এক রমণী;
ডাক হরকরার পায়ের আওয়াজে, ঘোমটা টেনে কিছুটা লাজে, ত্বরিত সুধায় অমনি –
‘কি ভায়া, এলো কি কিছু নতুন খামে ‘মোর উনার’ তরফ হতে
আছেন যিনি প্রবাসে বহু কষ্টে, কোনমতে?’

অন্য আরেকদিন,
হ্যাঁ, অন্য আরেকদিন!
ভিন্ন জেলা হতে বেফাঁস কিছু হয়ত লিখেছিল কেউ রাগে-দুঃখে,
গন্তব্যে খুললো খাম, অভিমানে বইলো ঝড়,
অবশেষে প্রাপকের নিঃশব্দ-হুঙ্কারে জুটলো বলি ভালে!
এমনভাবে পাকালো দলা যেন কোন এক ভোজনপটু মহাসুখে চিপলো
কাগজিলেবুর নির্যাস কাঁচাআমের ফালিতে রাঁধা মসুরির ডালে।

অন্য আরেকদিন,
হ্যাঁ, অন্য আরেকদিন!
পৌঁছেছিলাম এক শুভ্রহাসিনীর দ্বারে,
সখা তার বেশ সযতনে লিখেছিল প্রেমগাঁথা আমার রঙিন প্যাডে,
মুদ্রিত ছিল কোণে ‘যাও পাখি বলো তারে সে যেন ভুলেনা মোরে!’
শুভ্রহাসিনীর অধরযুগল রোমাঞ্চে কাঁপে, যেন হাসি তারে নাহি ছাড়ে!
আমায় পাঠ্যপুস্তকের পাতায় রেখে পড়ছিল লুকিয়ে সে একাধারে,
হঠাৎ বাবার আগমনে গুজলো সে মোরে স্বীয় বক্ষোরুহর ভাঁজে!
জানতে চেয়ো না শিহরণ কিছু জেগেছিল কি মোর শিরা-উপশিরাহীন রক্তশূণ্য দেহে!
যদি কিছু পেয়েও থাকি সে ছিল আমার পাওয়া, এ নিয়ে আর ফেলোনা আমায় লাজে!

অন্য আরেকদিন,
হ্যাঁ, অন্য আরেকদিন!
ঝড়-তুফানের মাঝে, বিশাল দায়িত্ববান ডাকপিয়ন এক করছিল বিলি চিঠি বেশ,
আমিও ছিলাম বোঝায়, হঠাৎ পাগলা হাওয়ায় পড়েগেলাম জলভরা খন্দকে,
গায়ে যা ছিল লিখা তাবৎ গেলো মুছে, সব হলো শেষ।
জানি না তাতে কার কি হয়েছিল ক্ষতি – হয়ত ছিল সে গরীব কিম্বা মহামানী,
শান্তি পেয়েছিলাম ভেবে, বোধহয় বিধাতা মোরে দিয়েছেন ছাড় দূর করে কলঙ্ক একটুখানি।

অন্য আরেকদিন,
হ্যাঁ, অন্য আরেকদিন!
দিনমজুর বাতেন আলী আমায় নিয়ে গেলো পাঠশালার হেডমাস্টারের কাছে,
বললো, ‘মাস্টোর সাব্‌, আমার চিডিডা পড়ে দেন।‘’
পড়া শুরু করতেই মাস্টারের চেহারা গেলো পাল্টে, চোখে এলো জল!
বাতেন শুধায় – ‘‘কি লিখেছে মোর ভাই?’’
জবাব পেলো – ‘’বড় কঠিন ভাষায় লিখা চিঠি বুঝার সাধ্য নাই!’’

অন্য আরেকদিন,
হ্যাঁ, অন্য আরেকদিন!
বিলাত-পড়ুয়া যুবকের কাছে গেলাম বাবার কথা নিয়ে,
বিষয়বস্তুর আভাসে ছিল ছোটবোনের বিয়ে।
‘পর সমাচার’ এর অনেক পরে, ‘ইতি’-র গা ছুঁয়ে,
বাঁয়ের মার্জিনে উল্লম্বভাবে লিখা ‘বিঃদ্রঃ’-য়ে লিখেছেন পিতাঃ
‘বাবা, তোর মায়ের শরীরটা তেমন ভালো নেই, দোয়া করিস্‌’;
বিয়ের খবরে উচ্ছ্বসিত যুবক মায়ের খবরে হলো শঙ্কিত বিভূঁইয়ে।
যুবক তাকিয়ে ছিল পলকহীন ঐ ‘বিঃদ্রঃ’ এর অতলে, জানি না কতক্ষণ,
চোখেরপানি গড়িয়ে ছিল তার ভাঙামন।

সে যাক্‌, আরো অনেক কথা আছে বলার বাকি,
স্মৃতিচারণ করলাম কিছু টুকিটাকি।।
সময়ের স্রোতে এলো ভেসে টেবলেট আর স্মার্ট ফোন সাথে নিয়ে শত অ্যাপ্‌স্‌
– যেন সতিনের এক দল!
হলো আমার অস্তিত্ব শঙ্কিত, দেখে আনকোরা আধুনিকতার ঢল।

আইপ্যাড, আইফোন, নোকিয়া, স্যাম্‌সাং
সাথে আরো কত নব নব ঢং বিরাট মূল্য হাঁকে;
রহিম মাঝিরা এখনও পড়ে কাগজের চিঠি
গোমতী, সুরমা আর ইছামতীর বাঁকে।

তবুও কেনো যেন মনে হয় এসবকিছুই স্মৃতি,
হয়ত জীবন সায়াহ্নে লাইফসাপোর্টে আছি;
বিলুপ্তির শঙ্খনাদ অতিশায়ী শব্দতরঙ্গে ভেসে
জাগালো বুঝি শেষ বিদায়ের ভীতি।

অবজ্ঞা করছো? ঠিক আছে, বেশ!
হয়ত রাখবে তুলে অবহেলার চিলেকোঠায়,
নয়তো যাদুঘরের ডিস্‌প্লে-তে নিয়ে আবেগের রেশ।
হয়ত একদিন, হয়ত হাজার বছর পরে,
বিকাবো আমি নিলামে অকল্পনীয় দরে।

আবারও বলছি –
তোমাদের আমি চিরচেনা সে-ই চিঠি – কাগজের চিঠি,
সাদা কাগজে কালোর আঁখরে বোনা ভাবের লুটোপুটি।

এনামুল হক
রচডেল ইংল্যান্ড
১৪/০৫/২০১৭

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here