২০১৯ শেষে জীবনের এক নাতিদীর্ঘ সালতামামি : ১৯৪৮ সালে গরীব পোস্টমাস্টারের ঘরে জন্ম আমার, আব্বা গল্প বলার রাজা ছিলেন, বলতেন, ‘তোমাকে জন্মের পরেই হাসি দায়িত্ব নিয়ে নেয়, সকালে দিয়ে আসা হতো আর সন্ধ্যায় তুমি ফিরতে তোমার আদরের পিসি’র বাসা থেকে!”

আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করতাম,” আর আম্মা ?” আব্বা হেসে বলতেন,” তোমার মা ? একেবারে খুকী, ভাত রাঁধতে জানত না!” ১৩ বছরে আম্মার বিয়ে হয়! পাঠশালায় ভর্তি হই রাজনগরে , মৌলভীবাজার শহরের অনতিদূরে!

তারপর আব্বা বদলি হন পাথারিয়ার দক্ষিণভাগে! আমার চোখ কান খুলতে শুরু করে তখন! সেসময় খুব জমজমাট ফুটবল হতো আর কাবাডি! পরে এম পি হয়েছিলেন, ইমানুদ্দিন চাচা দুর্দান্ত খেলতেন, সিলেটে খেলেছেন, এম সি কলেজ একাদশেও!

খেলাধুলায় জোঁক সেই থেকেই! পাঠশালার স্যার’রা এতো dedicated ছিলেন যে বাসায় রাতে এসে গোয়েন্দার মতো দেখতেন যে পড়ালেখা করছি না ফাঁকি দিচ্ছি! মোশাররফ হোসেন স্যার ছিলেন, তাঁকে দক্ষিণভাগের প্রবীণ বাসিন্দাদের মনে থাকার কথা!

জুড়ি ও হবিগঞ্জ কয়েকমাস কাজ করে আব্বা পৃথিমপাশা চলে আসেন! আমি তখন বেশ লায়েক, হাই স্কুলে যাই! বিহারের নায়েব উদ্দিন আজাদ হেডমাস্টার ছিলেন, নবাবদের স্কুল,”আলী আমজাদ হাই স্কুল”, কড়া অংকের সমর স্যারের কথা মনে পড়ে!

তখন থেকেই আমি আব্বার রাতের আড্ডায় আড়িপাতা শুরু করি, যা আমার কলেজ গমন পর্যন্ত অব্যাহত ছিলো! আন্তর্জাতিক রাজনীতি, ব্রিটিশ ভারতের ইতিহাস, রাজারাজড়াদের গল্প [বিশেষ করে রাজা চাচা লখনৌয়ের নবাবদের গল্প বলতেন!], মনোবিজ্ঞান, দেশে দেশে মানুষের বিচিত্র আচরণ ও জীবনযাপন!

৬০ বছর পরে অতীত নিয়ে যখন ভাবি, তখন বুঝি যে সেসব গল্পের বিষয়বস্তু আমার শিশুমনে গভীর রেখাপাত করে! আর তখন থেকে বই পড়ার নেশা পেয়ে বসে আমাকে দস্যু বাহরাম, দস্যু মোহন দিয়ে আরম্ভ! পরের গন্তব্য ছিলো ঢাকাদক্ষিণ যেখানে আমি স্বর্গত পদ কাকার বাড়ীর লাইব্রেরী অবাধে ব্যবহারের সুযোগ পাই!

দেব সাহিত্য কুটিরের প্রকাশনার তাবৎ ছিলো সেখানে! নতুন নতুন বন্ধুত্ব হয়, মাঠে খেলাধুলায় অংশ নেই! আমার শৈশব কৈশোর ব্যাপক আনন্দের ছিলো! এস এস সি ঢাকাদক্ষিণ থেকেই! বাংলাদেশে হৈ চৈ ফেলে দেওয়া ক্যালিফোর্নিয়ার প্রদীপ দা’র ছোট ভাই প্রতীম [অকালে চলে গেলো!]

প্রথম বিভাগ পায় কিন্তু ইংরেজি দুই পেপারে ও পেয়েছিলো ৯৯ আর আমি ১০০, এ নিয়ে আমাদের পরিণত বয়সে আমরা প্রচুর হাসাহাসি করেছি! কলেজে গিয়ে আমি রাতারাতি স্বাধীন হয়ে গেলাম, লেখাপড়া ছেড়ে, খেলা, আড্ডা, নাটক, মতিন স্যারের বাসায় আবৃত্তির রেওয়াজ বেড়ে গেলো !

I, quite frankly, lost the focus! যা হবার তাই হলো !  খেলা, আবৃত্তি, নাটক ইত্যাদিতে অনেক পুরস্কার পেলেও এম এ তেও সেকন্ড ক্লাস সেকন্ড হয়ে রয়ে গেলাম আমি চটে মটেই তো !

তবে চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ‘পূর্ব পাকিস্তান আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় টেনিস “শিরোপা আমার নেতৃত্বে এসেছিলো এবং আমি খেলায় স্কলারশিপ ও পেয়েছিলাম!
বাংলাদেশে চাকরীর stepping stone বলা হয় কলেজের মাস্টারি, তাই করলাম ৫ বছর ১৯৭৭ অবধি!

তবে শ্রীমঙ্গলের বছরগুলো খুব আনন্দময় ছিলো! কয়েকমাস চা বাগানে ভালো যায়নি, মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায় আমার জীবন সংশয় হয়ে গিয়েছিলো প্রায়! ফেডারেশন অফ চেম্বারসের বহু গল্প করেছি! UNCTAD/GATT এর এক বহুজাতীক কোর্সে আমি দিল্লীতে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করি আর সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশের বানিজ্য মেলায় ও গিয়েছিলাম।

দুটো সফরই ২১ দিনের করে ছিলো! সোনারগাঁও হোটেলে ১২ বছর আমার বাংলাদেশের জীবনের শেষ অধ্যায়! CHART Conference লুসিয়ানার নিউ অরলিন্সে, সিঙ্গাপুর ও জহুর বারু [মালয়েশিয়া] on the job training এবং পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়ে [Cornell University, present ranking in the world is 17 and member of the famed US Ivy League] এক মাসের এক কোর্সে অংশগ্রহন আমার মাইলফলক!

কানাডার ২৫ বছর এই সদাশয় সরকারের মেহমান হিসাবেই কাটিয়ে দিলাম, এ কথা বলতে আমি লজ্জা পাই না কারণ আমি চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ছুটাছুটি করেছি ,” ফ্রেঞ্চ জানো ? “একই প্রথম প্রশ্ন আসতো, আর আমি এতিমের মতো জবাব দিতাম, ” আজ্ঞে না!” তবে রাস্তা মাপ! স্কুলে কলেজে আমার চাকরি পাবার সব চেষ্টা নিস্ফল হয়!

HR অভিজ্ঞতা কাজে আসেনি, মূলত উন্নত বিশ্বে HR এ মেয়েরা কাজ করে আর আমার প্রেক্ষাপট হলো hiring, firing and disciplining employees আর এই দেশে যেখানে প্রায় zero unemployment, এরা সবিশেষ নজর দেয় to retain employees, so two different ball games!

বেকামিয়াব রয়ে গেলাম! তবু আমার কোনো আফসুস নেই, এই অবসরে আন্টারটিকা বাদে সব মহাদেশের ৩৭টি [টার্গেট ৫০ মরার আগে] দেশে গেছি, একখানি বই ” শেকড়ের টান” লিখেছি আর সবচেয়ে বড়ো অর্জন আমার পুত্ররত্ন ইশমাম, আমার সর্বস্ব ঢেলে দিয়ে আমি ওকে গড়েছি, অচিরেই গ্রাজুয়েট ইঞ্জিনিয়ার হচ্ছে!

মেয়ে নাবীলার প্রতি আমি নজর দিতে পারিনি বলে আমার লজ্জার শেষ নেই তবে মেয়েটি আমার বেজায় লক্ষী! আমার ৭২ চলছে বয়স, আজ রাতেই ইহলীলা সংবরণ করতে পারি তা আমি ভালোই জানি, কিন্তু স্রেফ এইটুকু বলে শেষ করবো যে আমার জীবনে কোনো হতাশা নেই, আফসুস নেই!

ব্যর্থতা আছে যা আমাকে বিব্রত করে না, সমস্যা আছে, সবারই থাকে, আমি গায়ে মাখি না ! একমাত্র দোয়া চাই যেন আমি আমার বাবার মতো [লন্ডনের কবরস্থানে শায়িত শান্তির মাঝে ] নিরোগ মরতে পারি! সবাই আনন্দে থাকুন, নিরাপদ থাকুন এবং শান্তিতে থাকুন !

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here