অস্ট্রেলিয়ার কাছে বড় ব্যবধানে হেরেছে বাংলাদেশ

অস্ট্রেলিয়ার কাছে বড় ব্যবধানে হেরেছে বাংলাদেশ – ছবি: এএফপি

বাংলাদেশের ক্রিকেটে কিছুদিন পরপরই তরুণ মুখ উঠে আসে। তাঁরা কিছুদিন দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করেন এবং এরপরই পথ হারান। ফলে গত এক যুগে বাংলাদেশের ক্রিকেট আসলে চলেছে এ পাঁচজনের ওপর। কার্যত এখন দলের বাইরে চলে গেছেন মাশরাফি।

কিন্তু ২০১৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের ক্রিকেট মূলত এই পাঁচজনের ওপরই দাঁড়িয়ে ছিল। ২০২১ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে মাশরাফি ছিলেন না। তামিমও চোট থেকে সময়মতো সেরে না ওঠায় ও ম্যাচ অনুশীলনের অভাবে যেতে পারেননি। বিশ্বকাপ শেষে বাংলাদেশের সেরা পারফরমারের তালিকায় বাকি তিনজনকে ঠিকই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে।

সে প্রসঙ্গেই প্রশ্ন উঠে যাচ্ছে। বাংলাদেশের ক্রিকেটের সব বড় সাফল্য এ পাঁচজনের হাত ধরে। বাদবাকিরা সবাই পার্শ্বচরিত্র ছিলেন। এবার নাহয় তাঁদের দুজন ছিলেন না, সাকিবও খেলেননি সব ম্যাচ। কিন্তু আগের সবগুলো বিশ্বকাপেই তো এই পাঁচজন খেলেছেন। সেই ছয় বিশ্বকাপে তাহলে কেন বাংলাদেশ বড় দলগুলোর বিপক্ষে সাফল্য পায়নি। এর উত্তর পরিসংখ্যান দিয়ে খোঁজার চেষ্টা করা হলো।

 মাশরাফি বিন মুর্তজা

মাশরাফি বিন মুর্তজামাশরাফি বিন মুর্তজা

ক্যারিয়ার:
ম্যাচ: ৫৪, উইকেট: ৪২, সেরা: ৪/১৯, ইকোনমি: ৮.০৪, স্ট্রাইক রেট: ২৭.১, গড়: ৩৬.৩৫

বিশ্বকাপ ক্যারিয়ার:
ম্যাচ: ২৩, উইকেট: ১৩, সেরা: ২/২৮, ইকোনমি: ৭.৯৪, স্ট্রাইক রেট: ৩৪.৯, গড়: ৪৬.২৩

বিশ্বকাপে টেস্ট খেলুড়ে দলের বিপক্ষে:
ম্যাচ: ১৭, উইকেট: ৭, সেরা: ২/২৮, ইকোনমি: ৮.৬৫, স্ট্রাইক রেট: ৫১.১৪, গড়: ৭৩.৭১

পরিসংখ্যান জানিয়ে দিচ্ছে, বিশ্বকাপে মাশরাফি ভালো করতে পারতেন না। ইকোনমি একটু কমলেও উইকেট পাওয়া বা দ্রুত উইকেট তুলে নেওয়ায় অতটা সাফল্য ছিল না তাঁর। আর টেস্ট খেলুড়ে দলগুলোর বিপক্ষে তাঁর পারফরম্যান্স রীতিমতো হতাশা জাগানো। মূল পেসার প্রতি ২ ম্যাচে ও ৭৩ গড়ে ১ উইকেট পেলে বড় দলের বিপক্ষে জয় পাওয়া কঠিন।

তামিম ইকবাল

তামিম ইকবাল

তামিম ইকবাল

ক্যারিয়ার:
ইনিংস: ৭৮, রান: ১৭৫৮, সেরা: ১০৩*, গড়: ২৪.০৮, স্ট্রাইক রেট: ১১৬.৯৬
শতক: ১, পঞ্চাশ: ৭, চার: ১৮৮, ছক্কা: ৪৫

বিশ্বকাপ ক্যারিয়ার:
ইনিংস: ২৩, রান: ৫১৪, সেরা: ১০৩*, গড়: ২৪.৪৭, স্ট্রাইক রেট: ১১৩.৪৬
শতক: ১, পঞ্চাশ: ১, চার: ৫২, ছক্কা: ১৫

বিশ্বকাপে টেস্ট খেলুড়ে দলের বিপক্ষে:

ইনিংস: ১৬, রান: ২০৮, সেরা: ৩৫, গড়: ১৩, স্ট্রাইক রেট: ৯১.৬৩
শতক: ০, পঞ্চাশ: ০, চার: ২৭, ছক্কা: ২

তামিমের পরিসংখ্যান একটু মজার। টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ার ও বিশ্বকাপ ক্যারিয়ারে খুব একটা পার্থক্য নেই তামিমের। এমনকি একমাত্র শতকও তাঁর বিশ্বকাপে। কিন্তু শুধু টেস্ট খেলুড়ে দলের হিসাব কষলে পরিসংখ্যান একদম রুগ্‌ণ হয়ে যায়। সে ক্ষেত্রে কোনো পঞ্চাশও নেই তাঁর, গড় মাত্র ১৩। স্ট্রাইক রেট এক শর কম। দলের মূল ব্যাটসম্যানের এমন ব্যাটিং দিয়ে জয় পাওয়ার আশা করা ভুল।

মুশফিকুর রহিম

মুশফিকুর রহিম

মুশফিকুর রহিম

ক্যারিয়ার:
ইনিংস: ৯০, রান: ১৪৬৫, সেরা: ৭২*, গড়: ১৯.৭৯, স্ট্রাইক রেট: ১১৫.৩৫
শতক: ০, পঞ্চাশ: ৬, চার: ১২২, ছক্কা: ৩৭

বিশ্বকাপ ক্যারিয়ার:
ইনিংস: ২৮, রান: ৪০২, সেরা: ৫৭*, গড়: ১৭.৪৭, স্ট্রাইক রেট: ১০৭.৪৮
শতক: ০, পঞ্চাশ: ১, চার: ৩৬, ছক্কা: ৮

বিশ্বকাপে টেস্ট খেলুড়ে দলের বিপক্ষে:
ইনিংস: ২২, রান: ৩১৬, সেরা: ৫৭*, গড়: ১৮.৫৯, স্ট্রাইক রেট: ১০৮.৫৯
শতক: ০, পঞ্চাশ: ১, চার: ৩১, ছক্কা: ৬

মুশফিকের ক্ষেত্রেও বিশ্বকাপে ফর্ম হারিয়ে ফেলার রোগ দেখা যাচ্ছে। ক্যারিয়ারের চেয়ে তাঁর গড় ও স্ট্রাইক রেট বিশ্বকাপে কমে যায়। এবার শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচের আগে বিশ্বকাপে তাঁর কোনো পঞ্চাশও ছিল না! তবে বড় দলের বিপক্ষে মুশফিকের পারফরম্যান্স বিশ্বকাপে ক্ষীণ শক্তির দলের তুলনায় ভালো। তবে সে পারফরম্যান্সও যে জয় এনে দেওয়ার মতো নয়, সেটা পরিসংখ্যানে চোখ বুলালেই বোঝা যাচ্ছে।

মাহমুদউল্লাহ

মাহমুদউল্লাহ

মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ

ক্যারিয়ার:
ইনিংস: ১০২, রান: ১৯৪০, সেরা: ৬৪*, গড়: ২৪.৫৫, স্ট্রাইক রেট: ১১৮.৮৭
শতক: ০, পঞ্চাশ: ৬, চার: ১৫০, ছক্কা: ৬০

বিশ্বকাপ ক্যারিয়ার:
ইনিংস: ৩০, রান: ৩৬৩, সেরা: ৫০, গড়: ১৮.১৫, স্ট্রাইক রেট: ১১০.৬৭
শতক: ০, পঞ্চাশ: ১, চার: ২৬, ছক্কা: ১১

বিশ্বকাপে টেস্ট খেলুড়ে দলের বিপক্ষে:
ইনিংস: ২০, রান: ২৫৪, সেরা: ৪৯*, গড়: ১৮.১৪, স্ট্রাইক রেট: ১০৩.২৫
শতক: ০, পঞ্চাশ: ০, চার: ২০, ছক্কা: ৬

টি-টোয়েন্টিতে গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের মূল ভরসা মাহমুদউল্লাহ। কিন্তু বিশ্বকাপ এলেই বদলে যান তিনি। এবার পাপুয়া নিউগিনির বিপক্ষে খেলা ইনিংসটির আগে বিশ্বকাপে তাঁর কোনো পঞ্চাশ ছিল না। বিশ্বকাপে তাঁর গড় ও স্ট্রাইক রেটও কমে যায়। বড় দলগুলোর বিপক্ষে মাহমুদউল্লাহর স্ট্রাইক রেট মাত্র ১০৩!

সাকিব আল হাসান

সাকিব আল হাসান

সাকিব আল হাসান

অলরাউন্ডার বলে সাকিবের হিসাবটা ব্যাটিং ও বোলিং—দুই দিক থেকেই করতে হচ্ছে।

ব্যাটিং ক্যারিয়ার:
ইনিংস: ৯৩, রান: ১৮৯৪, সেরা: ৮৪, গড়: ২২.৮১, স্ট্রাইক রেট: ১২০.৪৮
শতক: ০, পঞ্চাশ: ৯, চার: ১৯৩, ছক্কা: ৩৮

বিশ্বকাপ ক্যারিয়ার:
ইনিংস: ৩১, রান: ৬৯৮, সেরা: ৮৪, গড়: ২৬.৮৪, স্ট্রাইক রেট: ১২৪.৬৪
শতক: ০, পঞ্চাশ: ৩, চার: ৫৯, ছক্কা: ২৩

বিশ্বকাপে টেস্ট খেলুড়ে দলের বিপক্ষে:
ইনিংস: ২১, রান: ৪৮০, সেরা: ৮৪, গড়: ২৪, স্ট্রাইক রেট: ১২৪.৩৫
শতক: ০, পঞ্চাশ: ৩, চার: ৪১, ছক্কা: ১৫

এদিক থেকে পরিষ্কার যে একমাত্র সাকিবই বিশ্বকাপ এলেই জ্বলে উঠতে পছন্দ করেন। তাঁর গড়, স্ট্রাইক রেট, সেরা ইনিংস, চার-ছক্কা মারার প্রবণতা সবই বিশ্বকাপে বেড়ে যায়। বড় দলগুলোর বিপক্ষেও বিশ্বকাপে সাকিব ক্যারিয়ার গড়ের চেয়ে ভালো খেলেন।

সাকিব আল হাসান

সাকিব আল হাসান

বোলিং ক্যারিয়ার:
ম্যাচ: ৯৪, উইকেট: ১১৭, সেরা: ৫/২০, ইকোনমি: ৬.৬৬, স্ট্রাইক রেট: ১৭.৮, গড়: ১৯.৭৯

বিশ্বকাপ ক্যারিয়ার:
ম্যাচ: ৩১, উইকেট: ৪১, সেরা: ৪/৯, ইকোনমি: ৬.৪৩, স্ট্রাইক রেট: ১৬.১, গড়: ১৭.২৯

বিশ্বকাপে টেস্ট খেলুড়ে দলের বিপক্ষে:
ম্যাচ: ২১, উইকেট: ১৯, সেরা: ৪/৩৪, ইকোনমি: ৭.১৩, স্ট্রাইক রেট: ২৪.৩২, গড়: ২৮.৮৯

বোলিংয়েও বিশ্বকাপে সাকিব ক্যারিয়ারের চেয়ে বেশি উজ্জ্বল। ইকোনমি, স্ট্রাইক রেট সবই ভালো হয়ে যায় তাঁর। তবে বড় দলের বিপক্ষে তাঁর বোলিং পারফরম্যান্সে একটু অবনতি হয়। তবে সেটাও বিশ্বমানেরই থাকে সাকিবের।

পাঁচ জনের ওপর ভরসা করে আর কত দিন খেলবে বাংলাদেশ?

পাঁচ জনের ওপর ভরসা করে আর কত দিন খেলবে বাংলাদেশ? ছবি: এএফপি

তাহলে পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে, বিশ্বকাপে সাকিব ছাড়া, বাংলাদেশের বাকি চার তারকাই উজ্জ্বল নন। একটি দল ১১ জন নিয়ে মাঠে নামে। এর ব্যর্থতার দায় কোনো ব্যক্তির নয়। এক দশক ধরে যাঁরা সেরাটা দিচ্ছেন, তাঁদের তো অবশ্যই নয়। কিন্তু এ পরিসংখ্যানই বাংলাদেশের ক্রিকেটের একটা বড় ভুল দেখিয়ে দিচ্ছে। ভালো পাইপলাইন না থাকায় খেলোয়াড় উঠে না আসার ঘাটতি এই পাঁচজন বছরের পর বছর পূরণ করে দিয়েছেন। এ কারণেই গত এক দশকে ক্রিকেটে বেশ কিছু সাফল্য পেয়েছে বাংলাদেশ।

কিন্তু টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে যখন তাঁরাই রং হারাচ্ছেন, তখনই দলের ভেতরের ঘাটতি প্রকাশিত হচ্ছে। এ কারণেই টেস্ট খেলুড়ে দলের সঙ্গে ২৩টি ম্যাচ খেলে ২২টিতেই হেরেছে বাংলাদেশ। কারণ, অভিজ্ঞ ক্রিকেটাররা ব্যর্থ হলে দায়িত্ব নেওয়ার মতো তরুণের আবির্ভাব হচ্ছে না বাংলাদেশের ক্রিকেটে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here