সংবিধানে প্রবাসীদের ভোটাধিকারের বিষয়ে পরিষ্কার ইঙ্গিত আছে, যা ভোটার হওয়ার প্রশ্নে কোন অন্তরায় নয়। তাহলে প্রবাসীদের ভোট দেবার বিষয়ে কেন কার্যকর সিন্ধান্ত নেয়া হচ্ছে না। এখানে অনীহা কিসের বা কাদের সেই প্রশ্ন আসাটা কি স্বাভাবিক না? বাংলাদেশের নাগরিকরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চাকুরী, লেখাপড়া, গবেষণা, ব্যবসা, প্রশিক্ষণ ইত্যাদি কারনে অবস্থান করছেন। অনেকে বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী দৈতনাগরিকত্ব নিয়ে বিভিন্ন দেশে বসবাস করছেন। বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী প্রত্যেক বৈধ নাগরিকের ভোটাধিকার স্বীকৃত তাহলে কেন প্রবাসীদের ভোটাধিকার নেই এবং ভোট দিতে পারছেন না?

জাতীয় সংসদ কর্তৃক প্রণীত ’ভোটার তালিকা সংশোধন আইন ২০০৯ এর ৬ নং আইন মোতাবেক কোন ভোটার এলাকা বা নির্বাচনী এলাকার রেজিষ্ট্রেশন অফিসার, কমিশনের তত্ত্বাবধান, নির্দেশনা এবং নিয়ন্ত্রণাধীনে, উক্ত ভোটার এলাকা বা নির্বাচনী এলাকার জন্য নির্ধারিত পদ্ধতিতে একটি খসড়া ভোটার তালিকা প্রণয়ন করিবেন, যাহাতে এমন প্রত্যেক ব্যক্তির নাম অর্ন্তভূক্ত থাকিবে যিনি, যোগ্যতা অর্জনের তারিখে- (ক) বাংলাদেশের একজন নাগরিক হন; (খ) আঠারো বৎসরের কম বয়ষ্ক নহেন; (গ) কোন উপযুক্ত আদালত কর্তৃক অপ্রকৃতস্থ বলিয়া ঘোষিত নহেন; এবং (ঘ) উক্ত ভোটার এলাকা বা, ক্ষেত্রমত, নির্বাচনী এলাকার অধিবাসী বা অধিবাসী বলিয়া গণ্য হন।

একই আইনে (৬) উপ-ধারা (১) এ যা কিছুই থাকুক না কেন, কোন বাংলাদেশী নাগরিক বিদেশে বসবাস করিলে, তিনি সর্বশেষ যে নির্বাচনী এলাকায় বসবাস করিয়াছেন অথবা তাহার নিজ বা পৈতৃক বসতবাড়ী যে স্থানে অবস্থিত ছিল বা আছে তিনি সেই এলাকার অধিবাসী বলিয়া গণ্য হইবেন।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে সংকটের মধ্যদিয়ে যাচ্ছে। বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচন কিভাবে বা কোন প্রক্রিয়ায় হবে তা নিয়ে চলছে বিভিন্ন ধরনের টানাপোড়ন, সংলাপ হওয়া না হওয়া, চিঠি চালাচালি, ফোনালাপ, হুমকি-ধামকি, কূটকৌশল, বিদেশি কূটনীতিক ও নানা সংস্থার দেনদরবার, তদ্বির ও চাপ এর পরিস্থিতিতে এই আলোচনা কতটা গুরুত্ব পাবে সেই প্রশ্ন মাথায় রেখেই কথাগুলো বলছি এবং বারবার বলব। কারণ একটি গণতান্ত্রিক সমাজের জন্য এই দাবী ও অধিকার প্রতিষ্ঠা অতি গুরুত্বপূর্ণ।

একজন নাগরিক কেবল একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নেই অংশগ্রহণ করেনা রাজনৈতিক কর্মকান্ডেও অংশগ্রহণ করে। প্রতিটি নাগরিকের প্রধান রাজনৈতিক অধিকার ও কর্তব্য হচ্ছে তার ভোটাধিকার প্রয়োগ করা। কিন্তু নাগরিক হিসেবে প্রবাসীরা দেশের অর্থনীতিতে ভুমিকা রাখলেও তাদের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক অধিকার ‘ভোটাধিকার’ প্রয়োগ করতে পারছেন না বছরে পর বছর!

বিগত দুই দশকেরও অধিক সময় ধরে এই দাবীতে ও বিষয়ে অনেক কথা হয়েছে কিন্তু কোন অগ্রগতি হয়নি। বাংলাদেশের রাজনীতির শীর্ষ নেতৃত্বের অনেকেই একসময় বিদেশে ছিলেন, এখন তারা দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। নেতারা সরকারি, রাজনৈতিক, পরিবারিক, চিকিৎসা, হজ্ব ও ভ্রমণে প্রায়ই বিদেশে যান এবং তারা ঐ সব দেশে তার দলের নেতার কর্মীদের সাথে দেখা ও সভা-সমাবেশ করেন। প্রবাসীদের ভোট দেবার অধিকারের যৌক্তিকতা স্বীকার করলেও দেশে যেয়ে তাদের প্রতিশ্রুতি ভুলে যান!

প্রবাসীরা দেশের রাজনৈতিক সংকট, প্রাকৃতিক দূর্যোগ ও মানবিক বিপর্যয়ের সময় দরদি নাগরিক হিসেবে তাদের দায়িত্ব পালন করে। কিন্তু এই মানুষগুলো নিজ দেশ ছেড়ে দেশের ও জীবনের নানা বাস্তবতায় পরদেশে অবস্থান করার কারনে পরিণত হয়েছে ’প্রবাসী এবং বাংলাদেশের ভোটাধিকার প্রয়োগ বঞ্চিত বৈধ নাগরিক’!

প্রবাসীরা বিশ্বের উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে বসবাসের কারনে তাদের মধ্যে একটি স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে, যা একটি আধুনিক ও গণতান্ত্রিক সমাজ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বৈদেশিক মুদ্রা প্রেরণের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে শুধু নয় একই সাথে সামাজিক এবং মানবিক উন্নয়নেও প্রবাসীরা কাজ করছে।

 

দক্ষিন এশিয়ার বিকাশমান ও উদিয়মান অর্থনীতির দেশ বাংলাদেশ বিশ্বের শ্রেষ্ট দশটি রেমিটেন্স গ্রহণকারী দেশ হিসেবে ভারত, চীন, মেক্সিকো, ফিলিপাইন, পোল্যান্ড, নাইজেরিয়া, মিশর, রুমানিয়ার সাথে অবস্থান করছে। বিগত ৩০ বছরে প্রায় ৬৮ লক্ষ মানুষ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গেছেন এবং বসবাস করছেন (প্রবাসীদের সঠিক চিত্রটা হবে ভিন্ন)। এই সময়ে (১৯৭৯-২০০৮) ধারাবাহিক ভাবে বাংলাদেশের রেমিটেন্স প্রবাহ বেড়েছে গড়ে ১৯ শতাংশ হারে যা বাংলাদেশের জিডিপি’র প্রায় ১২ শতাংশ এবং ২০১২ সালের হিসেব অনুযায়ী রেমিটেন্সের পরিমান বের হয়েছে ১২ বিলিয়ন ডলারের উপরে। আর এই প্রবাসী নাগরিকদের ভোটাধিকার প্রদানের দায় বোধ না করাটা কি কোন গণতান্ত্রিক সরকারের যৌক্তিক আচরণ?

বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে ‘অ্যাবসেন্টি ব্যালট সিস্টেম’ চালু আছে বাংলাদেশেও তা করা সময়ের দাবী। যেমন; মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকরা পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুক তার ভোট দিতে পারে। অস্টেলিয়ার নাগরিকরা যদি ভোট না দেন সেক্ষেত্রে তাদের জরিমানা করার ব্যবস্থা আছে। প্রবাসী জাপানি নাগরিকরাও ভোট দিতে পারেন। কানাডার নাগরিকরা যারা স্বল্পকালীন অথবা দীর্ঘকালীন সময়ের জন্য কানাডার বাইরে আছেন তাদের জন্য রয়েছে মেইলিং পোলিং সিসটেম, আর যারা ভোটাদানের নির্ধারিত তারিখের আগেই কানাডা ছাড়বেন, তাদের জন্য রয়েছে অ্যাডভান্স পোলিং সিসটেম। বিশ্বের অন্যতম রেমিটেন্স গ্রহণকারী দেশ ফিলিপাইনও তার প্রবাসী নাগরিকদের জন্য ভোটের ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছে। হংকং, থাইল্যান্ড এবং সিঙ্গাপুরেও আছে অপটিক্যাল স্ক্যানিং ভোটিং সিস্টেম। বর্তমান ডিজিটাল যুগে প্রবাসীদের এই অধিকার পুরণ অনেক বড় কিছু নয়, কেবল প্রয়োজন সরকারের সদিচ্ছা।

 

পরিশেষে বাংলাদেশের একজন প্রবাসী নাগরিক হিসেবে প্রবাসীদের ভোটাধিকার প্রয়োগ বিষয়ে কিছু পরামর্শ রাখছি-

এক.  প্রবাসী কল্যান মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন দেশের দূতাবাসের তত্ত্বাবধানে ভোটার লিস্ট তৈরী করা

দুই.  প্রবাসীরা যে সব দেশে অবস্থান করছেন সে সব দেশের দূতাবাসের মাধ্যমে ভোট নেয়ার ব্যাবস্থা করা অথবা ডাকযোগেও সরাসরি ভোট নেয়া যেতে পারে।

তিন.  অর্থ, আমলাতন্ত্র, কারিগরি বা পদ্ধতিগত কোন জটিলতা থাকলে তা যতশীঘ্র সম্ভব দূরকরা।

চার.   কি পরিমান বাংলাদেশী নাগরিক পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছে তার একটি সঠিক ডাটাবেস তৈরী করা হোক এবং তা বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে হতে পারে। সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যদি আন্তরিক হন তাহলে ২-৩ মাসের মাসের মধ্যে এই ভোটার তালিকা প্রণয়ন করা সম্ভব। বাংলাদেশে ১৫ দিনেও ভোটার তালিকা তৈরী করার নজীরও আছে।

প্রবাসীদের এই ‘যৌক্তিক দাবী’ কেবল কিছু লেখালেখি ও কথাবার্তার মধ্যেই সীমিত না রেখে, ভোটাধিকার প্রয়োগের ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করে প্রবাসীদের দেয়া হোক তাদের অবদানের স্বীকৃতি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here