১৯৯৬ সালের ঘটনা। ৩৫ বছরের ব্রিটিশ-বাংলাদেশী টগবগে তরুণ সিরাজ মিয়া বাংলাদেশে গিয়েছিলেন তাঁর স্ত্রী ও পাঁচ সন্তানের সাথে যোগ দিতে। সান্ডারল্যান্ড এলাকার রেস্টুরেন্ট মালিক সিরাজ মিয়া ঝকঝকে পশ্চিমা পোশাক পরিধান করে পকেটে নগদ চার হাজার পাউন্ড নিয়ে ঢাকা বিমান বন্দরে অবতরণ করেন। কিন্তু পরিবারের সদস্যদের সাথে শেষ দেখাও হয়নি সিরাজের। ঢাকা বিমান বন্দরের পুলিশ ও কাস্টমস কর্মকর্তাদের ঘুষ দিতে অস্বীকৃতি জানানোর ফলশ্রুতিতে সিরাজ মিয়াকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়; থেতলে দেওয়া হয় তাঁর মাথা, পেট ও লিঙ্গ; খুঁজে পাওয়া যায়নি তাঁর পরনের কাপড়, পাসপোর্ট, লাগেজ ও নগদ অর্থ। সিরাজ মিয়া হত্যাকান্ডের বিচারের দাবিতে তখন ফুঁসে উঠেছিলেন বিলেত প্রবাসীসহ অনেকে; আলোচনা হয় ব্রিটেন ও বাংলাদেশের সংসদে।

বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা (বর্তমানেও তিনি প্রধানমন্ত্রী) হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িতদের গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সিরাজ মিয়ার বিধবা স্ত্রী শামসির বেগমও স্বামী হত্যার বিচারের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলেন। বিনা পয়সায় আইনী সহায়তা দিতে শামসির বেগমের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন ব্রিটেনের ব্যারিস্টার এমিলি থর্নব্যারি। কিন্তু জীবনতো থেমে থাকে না। স্বামীর বিচারের জন্য বছরের পর বছর বাংলাদেশে পড়ে থাকলে তো চলবে না। সংসার, সন্তানদের কথা ভেবে ব্রিটেনে ফিরে আসতেই হবে। আর দেশ ছেড়ে এসে বিদেশে বসে অন্যায়ের বিচার পাওয়া বাংলাদেশের মতো দেশে এখনও সুদূরপরাহত।

২০১১ সালে গ্রেটার ম্যানচেস্টারের রচডেল থেকে সিলেটের বিশ্বনাথে স্ত্রী ও এক পুত্রকে নিয়ে নিজের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন ৮১ বছর বয়স্ক হাশিম উদ্দিন ওরফে তাহির আলী। হঠাৎ একদিন ১৫ জনের একটি দুষ্কৃততকারী দল তাহির আলীর ঘরে ঢুকে তাঁকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপাতে থাকে। এ সময় তাহির আলীর ছেলে আজাদ মিয়া (২৫) বাবাকে বাঁচাতে দৌড়ে আসলে তাঁকেও ছুরিকাঘাত করে দৃষ্কৃতকারীরা। তাহির আলীর স্ত্রী মাহারুন নিসাকে টেনে নিয়ে হাত-পা বেঁধে বাথরুমে আটকে রেখে দৃষ্কৃতকারীরা নগদ অর্থ, স্বর্ণালঙ্কার ও জমির দলিলপত্র নিয়ে পালিয়ে যায়।

তাহির আলীর স্ত্রী মাহারুন নিসা হাত ও পায়ের বাঁধন খুলে ঘর থেকে বের হয়ে দৌড়াতে থাকেন আর সাহায্যের জন্য চিৎকার করতে থাকেন। তিনি স্থানীয় পুলিশ স্টেশনেও গিয়েছিলেন, কিন্তু কোনো সাহায্য পাননি। পরে স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় একটি গাড়ি যোগাড় করে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল আহত তাহির আলী ও তার ছেলে আজাদকে। গুরুতর আহত তাহির আলীকে হাসপাতালের নার্সরা মাথায় বেন্ডেজ লাগাচ্ছিলেন।

ওই অবস্থায়ই তাঁর মৃত্যু হয়। পুত্র আজাদ মিয়া প্রাণে বেঁচে গেলেও তাঁর মাথায় বেশ কয়েকটি সেলাই দিতে হয়। তাহির আলীর মেয়ে জোসনা বেগম জানিয়েছেন, জমি-জমার বিবাদের সূত্র ধরেই তাঁর বাবাকে হত্যা করা হয়েছে, কারণ জমি সংক্রান্ত একটি মামলায় আদালত তাঁর বাবার পক্ষে রায় দিয়েছিল।

ঘটনার আগে থেকেই প্রতিপক্ষের লোকজন তাহির আলীকে রাস্তাঘাটে তাঁকে উত্ত্যক্ত করতো এবং তাঁকে লক্ষ্য করে পাথর ছুঁড়ে মারতো বলে জানান জোসনা বেগম। বিশ্বনাথ এর তৎকালীন এমপি শফিকুর রহমান চৌধুরীর কাছে তাহির আলীর পরিবার কাঙ্খিত সহযোগিতা না পাওয়ার অভিযোগ করেছিলেন। ন্যায় বিচার পাওয়ার আশায় তাঁরা ব্রিটিশ ফরেইন অফিসেরও সহায়তা চেয়েছিলেন। তবে তাহির আলী হত্যার বিচার এখনও অপূর্ণ রয়ে গেছে।

২০১৩ সালের জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে স্বামী ও ১২ বছর বয়সের ছেলেকে নিয়ে লন্ডন থেকে বাংলাদেশের সুনামগঞ্জ জেলায় বেড়াতে গিয়েছিলেন রেহানা বেগম। ইস্ট লন্ডনের স্টেপনি গ্রীনের বাসিন্দা ৪৩ বছর বয়স্ক রেহানা বেগম দেশের বাড়িতে পৌঁছার দুই সপ্তাহের মধ্যে ২রা আগস্ট ছুরিকাঘাত করে খুন তাকে করা হয়। খুন করার পর তার বাড়ি থেকে সোনা-গয়না ও নগদ অর্থ নিয়ে যায় ৫-৬ জনের একটি দল। খুনের সাথে সংশ্লিষ্টতার সন্দেহে পরের দিনই রেহানা বেগমের স্বামীর আত্মীয় বশির মিয়াকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পুলিশের ধারণা, বিবাহ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার জের হিসাবে রেহানা বেগমকে খুন করা হয়েছে।

২০০৮ সালে দেশে-বিদেশে সমালোচনার ঝড় তুলেছিল ব্যারিস্টার রিজোয়ান হোসেইনকে ঢাকা বিমান বন্দরে নিযুক্ত নিরাপত্তারক্ষী কর্তৃক হাত-পা ভেঙ্গে দেওয়ার ঘটনায়। ওই বছরের ১৪ এপ্রিল রিজোয়ান হোসেইন হবিগঞ্জ থেকে ঢাকায় এসেছিলেন বোন ও বোনের পরিবারকে বিদায় দিতে। বোনকে বিদায় দিয়ে বিমানবন্দরেই এক পরিচিত ব্যাক্তির শ্বাশুড়িকে সাহায্য করতে এগিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। ঘটনার সূত্রে বিমান বন্দরের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত লোকজনের সঙ্গে তার বাক-বিতণ্ডা হয়। এরপর তাকে ধরে নিয়ে বিমানবন্দর ভবনের উপরের তলায় নিয়ে গিয়ে জোরপূর্বক একটি বিবৃতি লিখিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়। বিবৃতি লিখতে অস্বীকৃতি জানালে জনৈক নিরাপত্তা কর্মকর্তার নির্দেশে ব্যারিস্টার রিজোয়ান হোসেইনকে পাঁচ জনের একটি দল কয়েক দফায় লাঠিপেটা করে।

শরীরের বিভিন্ন জায়গায়, হাত-পায়ের হাড্ডিতে, পায়ের নিচে পিটিয়ে আধমরা করে অবশেষে সেই বিবৃতিটি লিখিয়ে নেয়া হয়। তাদের নির্দেশ মোতাবেক রিজোয়ান হোসেইন বিবৃতিতে লিখতে বাধ্য হন যে তিনি ‘‘অবৈধ ইমিগ্র্যান্টদের সহায়তা দিতে অবৈধভাবে বিমানবন্দরে প্রবেশ করেছেন’’। এরপর বিমানবন্দরের পেছনের দরজা দিয়ে বের করে দেওয়া হয় রিজোয়ান হোসেইনকে। ভীত-সন্ত্রস্ত ও মারাত্মকভাবে আহত রিজোয়ান নিকটবর্তী একটি মসজিদে প্রবেশ করে তাঁর কাজিন ও ড্রাইভারকে ফোন করেন। গণমাধ্যম ব্যাক্তিত্ব হওয়ার কারণে, হামলাকারীদের প্রত্যেকের নাম মনে রাখতে পারার কারণে এবং নিজের অদম্য চেষ্টার কারণে ব্যারিস্টার রিজোয়ান অবশ্য তার উপর হামলার একপ্রকার বিচার পেয়েছিলেন।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক শহরের বাসিন্দা ৫৯ বছর বয়স্ক মনসুর রহমান পাঁচ বছর পর ২০১৫ সালের জুন মাসে ঢাকায় ফিরেছিলেন ডাক্তার মেয়েকে দেখতে। জুলাইয়ের ১২ তারিখ মনসুর রহমানের ভাষানটেকের ফ্ল্যাটে ঢুকে ৬/৭ জনের একটি দল তাঁর স্ত্রী সুফিয়া বেগম ও কন্যা ঝুমুরকে রশি দিয়ে বেঁধে রেখে সুমন নামে একজনকে খুঁজতে থাকে। ওই নামে কেউ সেখানে থাকেনা জানানো হলেও দৃষ্কৃতকারীরা সেই ঘর থেকে কিছু স্বর্ণ, নগদ দেড় লাখ টাকা, দুটি ল্যাপটপ ও অন্যান্য মূল্যবান সরঞ্জাম নিয়ে যায়। প্রবীন মনসুর রহমান মসজিদ থেকে ফিরে এসে দুষ্কৃতকারীদের দেখতে পেয়ে তাদেরকে দমানোর চেষ্টা করেন। এসময় মনসুর রহমানের দেহের ৬/৭টি স্থানে ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যায় দুষ্কৃতকারীরা। হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকরা যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী মনসুর রহমানকে মৃত ঘোষণা করেন।

উপরে উল্লেখিত ঘটনাগুলো কয়েকজন অভাগা প্রবাসীর জীবন থেকে নেওয়া গল্প। নাড়ির টানে দেশে গিয়ে সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়েছিলেন ওইসকল প্রবাসী। আবার দেশে না গিয়েও প্রবাসে বসে প্রতিদিন বাংলাদেশকেন্দ্রিক অসংখ্য হয়রানির শিকার হচ্ছেন প্রবাসী বাংলাদেশীরা। যেমন : প্রবাসীদের জায়গার উপর তাদেরই নিকটাত্মীয়রা বাড়ি-ঘর নির্মাণ করছে, সীমানা প্রাচীর তুলে দিচ্ছে, প্রবাসীদের ঘর দখল করা হচ্ছে, ব্যবসা দখল করা হচ্ছে, প্লট ও ফ্ল্যাট কেনার পরও প্রবাসীদের দলিল ও দখল বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে না ইত্যাদি।

বাবা-মা, ভাই-বোন, নাতি-নাতনিসহ আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবকে দেখা, আত্মীয়-স্বজনের বিবাহ অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া, বর-কনে খোঁজা, নিকটাত্মীয়ের মৃত্যু, জায়গা-জমি ও সম্পত্তি ক্রয়-বিক্রয়, ব্যবসার লাভ-লোকসানের হিসাব নেওয়া, নতুন ব্যবসায় বিনিয়োগ করা- এমন হাজার ধরনের কাজ নিয়ে প্রবাসীরা সীমিত সময় হাতে নিয়ে বাংলাদেশে যান। প্রত্যেকটি বিষয়ের সাথেই সুখকর বিষয় যেমন থাকে, তেমনি থাকে সমস্যা ও বিবাদ। সীমিত সময়ের ভ্রমণের কারণে সুখের মুহূর্তগুলো প্রবাসীরা উপভোগ করতে পারলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে সমস্যা আর বিবাদগুলোর সমাধান করে আসতে পারেন না। আত্মীয়-স্বজনের নিজস্ব ব্যস্ততা, আত্মীয়-স্বজনের স্বার্থপরতা, কুচক্রী মহল, দখলদার, ঘুষখোর, রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব, গ্রাম্য বিরোধ, পারিবারিক বিরোধ ও প্রভাবশালীদের দৌরাত্ম্য প্রভৃতি কারণে বিদেশে বসে বিরাজমান সমস্যার সমাধান করা প্রায় অসম্ভব একটি বিষয়।

প্রবাসীদের নানা সীমাবদ্ধতার কথা চিন্তা করে তাদের বিভিন্ন সমস্যার সমাধানের জন্য বিশেষ কোনো ব্যবস্থা কোনো সরকারই আজ পর্যন্ত নেয়নি। আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে টাকা ধার করে, নিজের জায়গা-জমি, ভিটে-মাটি বিক্রি করে কিংবা বন্ধক রেখে গত কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশীরা বিদেশে যাচ্ছেন। নিজেদের শ্রমে উপার্জিত রেমিটেন্স পাঠাচ্ছেন আত্মীয়-স্বজনকে। ফলে সমৃদ্ধ হয়েছে বাংলাদেশের ফরেইন রিজার্ভ। বাংলাদেশকে রেকর্ড অঙ্কের রেমিটেন্স যোগাড় করে দিলেও শাসকগোষ্ঠীর কাছে প্রবাসীদের বাড়তি কোনো কদর অতীতেও ছিল না, এখনও নেই। ইদানীং প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় করা হয়েছে মূলত: বিদেশগামী লোকদের সহায়তা দিতে, জনশক্তি রপ্তানিতে দুর্নীতি কমাতে এবং জনশক্তি রপ্তানির নতুন বাজার খোঁজার লক্ষ্যে।

পিতৃভূমিতে প্রবাসীদের সমস্যাগুলোর সমাধানে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর কাজ নেই। বর্তমান সরকার প্রবাসীদের জন্য হেল্পলাইন চালু করে ই-মেইল ও টেলিফোনে তাদের বিভিন্ন অভিযোগ পুলিশ বিভাগকে জানানোর ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু এই প্রকল্পটি একেবারেই ওয়ান-ওয়ে পদ্ধতির। এখানে জবাবদিহিতার সুযোগ একেবারে নেই বললেই চলে। পুলিশ বিভাগ নিজেই যেখানে দুর্নীতিগ্রস্ত, সেখানে তাদের কাছে অভিযোগ দাখিল করে প্রবাসীরা কতটুকু নিরাপদ অনুভব করবেন, সেটিই বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ইদানীং প্রবাসীদের জন্য নতুন যে সমস্যা সংযোজিত হয়েছে তার নাম হচ্ছে ‘জাতীয় পরিচপত্র’। এই পরিচয়পত্র ছাড়া অফিস-আদালতে গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজও নাকি করা যায় না। প্রায় সব অফিস-আদালতেই নাকি জাতীয় পরিচয়পত্র দেখাতে বলা হয়। এই পরিচয়পত্রের বিকল্প হিসাবে বাংলাদেশী পাসপোর্টও নাকি গ্রহণ করা হয়না। বিদেশে বসে বাংলাদেশের হাইকমিশনগুলোর মাধ্যমে এই পরিচয়পত্র পাওয়া যায় না, আবার দুই-এক সপ্তাহ কিংবা এক মাসের জন্য দেশে গিয়ে প্রবাসীদের পক্ষে তা বানানোও সম্ভব হয় না। বাংলাদেশে গিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র সংক্রান্ত সমস্যা এড়াতে তাই বাংলাদেশ হাইকমিশনের মাধ্যমে জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়ার দাবি উঠেছে। ব্রিটিশ-পাকিস্তানিরা ইতোমধ্যে তাদের হাইকমিশনের মাধ্যমে জাতীয় পরিচয়পত্র সংগ্রহ করতে পারছেন।

মাতৃভূমিতে প্রবাসী বাংলাদেশী, পাকিস্তানি ও ভারতীয়দের সমস্যাগুলো প্রায় একই রকম। প্রবাসী ভারতীয়দের সুবিধার্থে বিভিন্ন ধরনের মামলা-মোকদ্দমাকে দ্রুত বিচারের আওতায় আনা যায় কিনা- এই বিষয়ে কার্যকর আলোচনা হচ্ছে। আর ‘পাঞ্জাব ওভারসীজ পাকিস্তানিজ কমিশন’ গঠন করে এর সুফল ভোগ করতে শুরু করেছে পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রবাসীরা। ২০১৪ সালের নভেম্বর মাসে একটি আইন প্রণয়ণের মাধ্যমে পাঞ্জাবের প্রাদেশিক সরকার ওই কমিশন গঠন করে।

প্রবাসী বাংলাদেশীদের জন্যও এমন একটি কমিশন গঠন করা যেতে পারে। বাংলাদেশ সরকারের সাংবিধানিক স্বীকৃতি নিয়ে বিশেষভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়ে প্রবাসীদের নানা সমস্যার সমাধানে কাজ করতে পারে এই কমিশন। প্রবাসীদের অভিযোগের ভিত্তিতে কমিশন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কেন্দ্রীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ের কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করে ওই অভিযোগ সংক্রান্ত তথ্য জানা ও তার অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইবে।

পাশাপাশি অভিযোগের বিপরীতে বাংলাদেশে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া যায়, সেই বিষয়ে সম্ভাব্য পরামর্শও দিতে পারে কমিশন। কমিশনের সাথে সহযোগিতা করতে বাধ্য থাকবে সকল সরকারি ও বেসরকারি দফতর ও কর্তৃপক্ষ। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ যে কোনো দফতর যদি কমিশনের সাথে সহযোগিতা না করে তবে তাদেরকে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে জবাবদিহি করা এবং আইন ভঙ্গের দায়ে বিচারের মুখোমুখি করার বিধান রাখা যেতে পারে।

‘পাঞ্জাব ওভারসীজ পাকিস্তানিজ কমিশন’ প্রাদেশিক সরকারের অধীনে পরিচালিত হলেও সেটিকে কিছু সুনির্দিষ্ট ক্ষমতা দেওয়ার কারণে পক্ষান্তরে প্রবাসী পাকিস্তানিরাই ক্ষমতায়িত হয়েছে। প্রবাসী বাংলাদেশীরা গত কয়েক দশক ধরে নানাভাবে ক্ষমতায়িত হওয়ার চেষ্টা করছে। স্বদেশে নিজেদের নানা সমস্যার সমাধান করতে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে প্রবাসীদের অংশগ্রহণ, সংসদে প্রবাসীদের জন্য আসন সংখ্যা সংরক্ষণ, প্রবাসীদের ভোটাধিকার দেওয়া সহ বিভিন্ন দাবিতে ধারাবাহিকভাবে আন্দোলন করে আসছে প্রবাসীদের একটি অংশ।

এই অংশের ধারণা, জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়ে সরকার ও প্রশাসনের সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় নিজেদের সম্পৃক্ত করতে পারলেই প্রবাসীদের সমস্যার সমাধান করা যাবে। সাধারণ প্রবাসীরা কিন্তু কখনও রাজনৈতিক ক্ষমতা চায়নি, চেয়েছে তাদের নাগরিক অধিকার। প্রবাসীদের বঞ্চনার সুযোগ নিয়ে রাজনৈতিকভাবে উচ্চাকাঙ্খী কতিপয় প্রবাসী বছরের পর বছর বোঝানোর চেষ্টা করেছেন যে, প্রবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে প্রবাসীদের রাজনৈতিক শক্তি প্রয়োজন। এরই ধারাবাহিকতায় প্রবাসীদের সমর্থন আদায় করে নানা প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিলেত থেকে বাংলাদেশে ফিরে গিয়ে জাতীয় সংসদের সদস্যও নির্বাচিত হয়েছেন একাধিক ব্রিটিশ-বাংলাদেশী। কিন্তু এই সকল এমপি ব্যাক্তিগত পর্যায়ে কিছু কল্যাণমূলক কাজ ও এলাকাভিত্তিক কিছু উন্নয়নমূলক কাজ করা ছাড়া প্রবাসীদের জন্য সামষ্টিকভাবে কল্যাণমূলক কোনো নীতি প্রণয়ন কিংবা আইন প্রণয়ণে এখনও ব্যর্থ।

বাংলাদেশের এমপি-মন্ত্রীরা বিলেত-আমেরিকায় সফরে এলে প্রবাসীরা তাদের কাছে ধর্ণা দেন, নানা সমস্যার সমাধান করার আবেদন জানান। কিন্তু এই ধরনের আবেদনগুলো নেহায়েত অনানুষ্ঠানিক। ফলে এসব সমস্যাকে আমলে নেওয়া না-নেওয়া পুরোটাই নির্ভর করে এমপিদের সদিচ্ছার উপর। জবাবদিহিতার বাধ্যবাধকতা এখানে নেই। তবে প্রবাসীদের জন্য কমিশন গঠিত হলে দেশের মন্ত্রী, এমপি, চেয়ারম্যানদের অনুগ্রহের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে না প্রবাসীদের। বরং কমিশনের তৎপরতার কারণে তাঁরা আইনগতভাবে বাধ্য হবেন প্রবাসীদের নাগরিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করতে। কেননা, তখন যোগাযোগ হবে প্রতিষ্ঠান বনাম প্রতিষ্ঠান। প্রবাসী কমিশন প্রবাসীদের অভিভাবক ও প্রতিনিধি হিসাবে কাজ করবে। আর প্রবাসী কমিশনের অভিযোগ, অনুযোগ, পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করবে বাংলাদেশের সরকার এবং সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন দফতর ও প্রতিষ্ঠান।

প্রবাসী বাংলাদেশীরা একবারই রাজনৈতিক আন্দোলনে নেমেছিল। সেটি ছিল ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার দাবিতে। বর্তমান শান্তিকালীন সময়ে প্রবাসীরা রাজনৈতিক ক্ষমতা চায় না, চায় নাগরিক অধিকার। কেননা, কোনো সরকারকেই প্রবাসীরা তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসাবে দেখতে চায় না। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন হোক কিংবা বিএনপি নেতৃতত্বাধীন হোক অথবা অন্য যে কোনো ধরনের সরকারই হোক, সকল ধরনের ক্ষমতাসীন সরকারের কাছেই প্রবাসীরা তাদের ন্যায্য অধিকার চায়।

যেহেতু দেশে গিয়ে প্রবাসীদের মাসের পর মাস কিংবা বছরের পর বছর থাকা সম্ভব নয়, সেহেতু প্রবাসীদের নাগরিক অধিকার পাওয়ার বিষয়টিকে ফাস্টট্র্যাকে (দ্রুতগতি সম্পন্ন) উন্নীত করা বাস্তবতার নিরিখেই প্রয়োজন। সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রবাসীরা এমপি-মন্ত্রী-চেয়ারম্যান হতে চায় না, বিভিন্ন পর্যায়ের জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে প্রবাস থেকে প্রার্থী পাঠানোর বিষয়েও প্রবাসীদের মধ্যে ব্যাপকভিত্তিক কোনো ঐকমত্য নেই। প্রবাসীরা কেবল চায় দেশে রেখে আসা আত্মীয়-স্বজন, সহায়-সম্পত্তির নিরাপত্তা, ব্যবসায়িক বিনিয়োগের নিরাপত্তা এবং সর্বোপরি নিজের নিরাপত্তা। তাই প্রবাসীদের স্বার্থ রক্ষায় কার্যকর প্রতিনিধিত্ব সৃষ্টি করতে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি প্রবাসী কমিশন গঠন দারুণভাবে সহায়ক হতে পারে।

লেখক : সাংবাদিক

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here