জীবনের এক একটি সময় আলাদা আলাদা প্রহরে ভাল করা থাকে । একটি দিনকে যেভাবে বেলা দিয়ে সম্বোধন করতে পারি ঠিক তেমনটাই । ছোটবেলার সময় গুলো কাটতো কেবল খেলা – ধূলা করেই, তখনো এমন করেই অপেক্ষার প্রহর গুনতাম – কখোন বিকেল হবে, কখোন মা একটু মাঠে খেলতে দেবে। একটু বড় হতে হতে সেই অপেক্ষার রঙ আরোও একটু রঙ্গীন হতে থাকলো যেন বেলা বেড়ে সবে বারোটা । যদিও মোবাইল ছিল না সে সময়, বন্ধুদের জন্য ছিল এক তীব্র আকর্ষন।

স্কুলের শেষ ঘণ্টা বেজে যেতেই পুরোদমে হৈ চৈ। সরকারী কলোনীতে বড় হওয়া কিশোর সময়কে বলে দিতে হতো না স্কুল ছুটির পর কি কি করতে হয়।

তখন কিন্তু বাবা মা স্কুল গেইটে দাঁড়ায়ানের মতো দাঁড়িয়ে থাকতেন না। স্কুল ছুটি হলেই আমরা উড়ন্ত মেঘ রোদ্র, ছেলে মেয়েতে ভেদাভেদের এতো হিসেব কষার সময় ছিল না।

এমন বরষা মাথায় কেবল দে – ছুট, ঘাড়ের বইয়ের বোঝা ভিজে জবু থবু তাতে কি হলো; আচার চাচা ঠিক ঠিক আমাদের জন্য অপেক্ষা করতেন তেঁতুল নিয়ে। ঝাপিয়ে পড়তাম পাঁচ আনা, দশ আনা যার যা আছে তাতেই খুব জমে যেত। বাড়ি ফিরতাম চুপি চুপি যেন রান্না ঘর থেকে মা কিছু না বোঝে, কিন্তু মায়েরা সব বুঝতেন।

কেউ কেউ জ্বরে ভুগে বকা খাওয়াতো আমাদের, তারপর আবার অপেক্ষা কখোন বাবা অফিস থেকে ফিরে আহ্লাদী মেয়েটিকে ডাক দেবে – কই গেলি মা .. আর ওমনি এক বেলার যতো অনুযোগ জমা করে দিতাম বাবার বুক পকেটে। প্রহর  যেতে থাকে, আমরা বড় হতে থাকি।

উচ্চ মাধ্যমিকের বেড়াজাল ডিঙ্গিয়ে কলেজে ঢুকেই হঠাৎ মনে হলো বেশ বড় হয়ে গেছি। জীবনে প্রথম পায়ে শাড়ী জড়াবো তাও পয়লা বোশেখে।

সেকী অপেক্ষা আমাদের; সময় কি আর কাটে ! কেউ মায়েরটা নিয়ে আয়রন করি কেউ বা বড় বোনেরটা। কুচি করতে গিয়ে কিযে হুলস্থূল অবস্থা! মা যাও এক খানা কুচি করে দিল, আঁচল আর রাখতে পারতাম না কিছুতেই।

সেই কুচি আর আঁচল পেঁচিয়ে এনালগ ক্যামেরায় হাসি মাখা ক্লিক ক্লিক। এর মধ্যেই কলেজ গেইটে লাল গোলাপ হাতে অপেক্ষা করতো কোন এক তরুন যার নাম আর শেষ অব্দি জানাই হলো না। মা বকা দেবে সেই ভয়ে বেচারার চেহারাটা পর্যন্ত ঠিক মতোন দেখতাম না।

কিন্তু কোন এক অদ্ভুত কারনে আমরা কলেজ শেষে তিন বন্ধু ওই হাবা গোবা ছেলেটার জন্যেই অপক্ষা করতাম। গোবেচারা বললাম এই কারনে যে সে ফুল নিয়ে ঠিক ঠিক দাঁড়িয়ে থাকতো, কিন্তু একটা গোলাপের বিনিময়ে সে একটা শব্দ বলতে চায় নি কোন দিন।

শুধু পিছু পিছু প্রাইভেট স্যারের বাড়ি অব্দি গিয়ে থেমে গেছে। ওর অপেক্ষাটুকু বুঝি ওই পর্যন্ত গিয়ে আর বেড়ে উঠতে পারে নি কিংবা তার গন্ডি ওই পর্যন্তই ছিল ।

কিন্তু, আমার অপেক্ষা ছিল; কোন এক ঘন বর্ষা মাথায় করে কোন এক রাজপুতুৱ ঘোড়া না হোক তিন চাকার রিক্সায় করে আমার কাছে আসবে, তারপর হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলবে -এই নাও তোমার জন্য চালতার আচার এনেছি, এঘন চলো দু’জন মিলে বৃষ্টিতে ভিজি। আমি সেই দুটুকরো আচারের লোভেই কীনা জানিনা সেই অচেনা রাজপুতুৱেৱ জনা অপেক্ষা করতাম।

সন্ধা আকাশে যখন বাজে পড়তো তখন আমার মনের সিন্দুকে থাকা মনপাখী কেবল আকুলি বিকুলি করে গাইতো ওগো বৃষ্টি আমার চোখের পাতা ছুয়োনা …. আমার এতো সাধের কান্নার জল ধুয়ো না। গোধূলির রঙ ছোড়ানো রোদ্যুর বেলার অপেক্ষা ঠিক কার জন্যে ছিল তা আজো আবিষ্কার করতে পারলাম না।

 

প্রহর যখন পাঁচিশের কোঠায়, তাকে কি পরিনত সময় বলা যেতে পারে। হয়তো বিজ্ঞান বলে দিয়েছে -তুমি এখন নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নিতে পারো। তাইতো যখন যেই বাতাস বয়ে গেছে শরীর স্পর্শ করে তাকেই মনে হয়েছে আসল সময়।

আসলে আসল সময়ের নাগাল কেউ এক জন্মেও পায় না, আবার কেউ কেউ এক মুহূর্তেও পায়। তবে পরিনত বয়সের অপেক্ষা বডড ভয়ংকর। এই অপেক্ষার মধ্যে আত্ম সন্মান বলে একটা ধারালো শব্দ জড়িয়ে থাকে।

আমি কারো জন্য অপেক্ষা করছি, কিন্তু মুখ দিয়ে বলতে পারছি না নিজের অনুভূতির কথা। বুঝে নেবার দায়টা যেন অন্য পক্ষের পুরোটাই আর এই বোঝাতে না পারার অযোগ্যতাই একটা সময় সম্পর্কের মধ্যে চিড় ধরিয়ে দিতে পারে। সন্ধ্যা রাতের অপেক্ষা গুলো বড় বেশী অভিমানী হয়, কারন রাত বাড়তে থাকে আর অপেক্ষার হাঁপিয়ে উঠতে থাকে।

জীবনের শেষ প্রহর বুঝি খুব বেশী নির্ভার অনেকটা দিন শেষে রাত নেমে আসার মতোই। চারিদিকে নিস্তব্ধতা, কোন অস্থিরতা নেই, কোন কামাতুরতা নেই, শুধু একটাই অপেক্ষা কখোন বিধাতার সেই ডাক আসবে। ছেলে – মেয়ে বা স্বামী কে কি করলো তা নিয়ে আর কোন মাথা ব্যাথা নেই। তিন বেলা পেটে ভাতে খেয়ে – ঘুমিয়ে আর প্রার্থনা করেই বুঝি কেটে যায় মানুষের শেষ সময়টুকু । কেউ যদি ভালোবেসে স্নেহের হাত রাখে তবেতো তা জীবনের বাড়তি বোনাসের লিস্টেই ফেলে দিতে চাই। নিরর্থক কারো বোঝা হয়ে বেঁচে থাকার জন্যে কোন অপেক্ষা নেই আমার। একটি সুন্দর – স্বাভাবিক মৃত্যুর গন্ধ নেবার জন্যই অপেক্ষার দরজার পাশে আলগোছে গড়িয়ে থাকে প্রতিক্ষন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here