ভারতের পররাষ্ট্রসচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা এক আকস্মিক সফর করে গেছেন বাংলাদেশে। এ সফরের নিশ্চিত কারণ জানা যায়নি। তবে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক ধরে রাখার তাগিদ সেখানে ছিল বলে ধারণা করা যায়।
ভারতের আঞ্চলিক প্রতিপক্ষ চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক, বিনিয়োগ ও বাণিজ্য সম্পর্ক ক্রমে ঘনিষ্ঠ হচ্ছে। চীন সম্প্রতি তিস্তা নদীবিষয়ক প্রকল্পে বাংলাদেশকে ঋণ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এ প্রকল্প তিস্তা নদী নিয়ে ভারত কর্তৃক বাংলাদেশকে বহু বছর ধরে ঝুলিয়ে রাখার একটি বিকল্প হতে পারে। এসব ভারতকে বিচলিত করতে পারে।
তিস্তা নদীর পানি ভাগাভাগি নিয়ে ভারত-বাংলাদেশ আলোচনা করছে কয়েক দশক ধরে। ২০১১ সালে এ চুক্তি হবে বলে জোর আশ্বাস দেওয়া হলেও আজও এ চুক্তি সম্পাদনে রাজি হচ্ছে না ভারত পশ্চিমবঙ্গের আপত্তির কথা বলে। অথচ তিস্তার উজানে পানি ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গকে রাজি করানোর চেষ্টা ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার করেছে বলে জানা যায়নি। আন্তর্জাতিক নদী তিস্তার পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কেন ভারতের আন্তপ্রাদেশিক বিরোধের বলি হবে, তারও কোনো সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি।
দুই দেশের সম্পর্কে ভারসাম্যহীনতার এ বিষয় প্রকাশ্যে কেউ স্বীকার করেন না। বিদায়ী ভারতীয় হাইকমিশনার রীভা গাঙ্গুলী দাস বরং সম্প্রতি প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে দুই দেশের মধ্যে এমন ভালো সম্পর্ক বিশ্বে আর নেই। সীমান্ত হত্যা, নদী চুক্তির অচলাবস্থা প্রসঙ্গগুলোও তিনি এমনভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, মনে হবে না যে এসব কোনো গুরুতর সমস্যা দুই দেশের মধ্যে।
দুই.
বাংলাদেশে এই ভারতবিরোধী মনোভাব কাম্য নয়, তবে এর পেছনে কিছু বাস্তব কারণ রয়েছে। শুধু সীমান্তে ভারতীয় বাহিনী কর্তৃক বাংলাদেশের নাগরিকদের হত্যার বিষয়টি বিবেচনা করলেই এটি বোঝা যাবে। পৃথিবীর কোনো সীমান্তে এমন একতরফা বেসামরিক নাগরিক হত্যার নজির নেই। ভারত বলে থাকে যে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী ও অপরাধীদের ঠেকাতে এটি করা হয়। অথচ ভারত এদের গ্রেপ্তার ও বিচার করে এমন বহু হত্যাকাণ্ড এড়াতে পারত।
প্রশ্ন উঠতে পারে, বাংলাদেশে তাহলে এমন প্রতিবাদ হয় না কেন? আমরা এর উত্তর নেপাল-ভারত সম্পর্কের দিকে তাকালে বুঝতে পারব। নেপালে প্রায় অর্ধশত বছর ধরে স্বাধীন ভারতের প্রতি অনুগত রাজতন্ত্র ছিল। সে সময়ে নেপাল ও ভারতের মধ্যে যে চুক্তিগুলো হতো, তাতে ভারতের স্বার্থ প্রাধান্য পেত।
যেমন গান্ধক ও কোশী নদী চুক্তি। নেপালের পররাষ্ট্রনীতি ও সমরনীতিতেও ভারতের প্রভাব বজায় ছিল। ভারত এভাবেই অভ্যস্ত ছিল এবং সে কারণে কয়েক বছর আগে নেপাল যখন নতুন সংবিধান প্রণয়ন করে, সেখানে ভারতের ইচ্ছার প্রতিফলন না থাকায় ভারত তা সহজভাবে নেয়নি।
৪০ থেকে ৫০ বছর ধরে নেপালে কার্যত কোনো ভারতবিরোধিতা না থাকলেও ভেতরে-ভেতরে জনগণের মনে যে তা কতটা জোরালো হয়ে উঠেছিল, তা টের পাওয়া যায় সম্প্রতি কে পি শর্মা অলি নেপালের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর। তিনি ভারতবিরোধী প্রকাশ্য ভূমিকা গ্রহণ করার পর নেপালের মানুষের ভারতবিরোধী মনোভাবও প্রকাশ্যে চলে আসে। ভারতের বিভিন্ন বিশ্লেষকের লেখা পড়লে মনে হয়, এটা যে এত দিন সুপ্তভাবে ছিল, তা তাঁরা বুঝতে পারেননি আগে।
ভারত সম্পর্কে বাংলাদেশের বঞ্চনাবোধ কম নয়। এর কিছু কারণ ওপরে বলেছি। এ ছাড়া রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প, ট্রানজিট, এনআরসি, এনসিসি, বাংলাদেশের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ, বাংলাদেশ সম্পর্কে অবজ্ঞামূলক মন্তব্য—এমন বিষয়গুলোও কম গুরুতর নয়। আমার আশঙ্কা, নেপালের মতো বাংলাদেশেও যেকোনো রাজনৈতিক মহল সুবিধামতো সময়ে এমন ভারতবিরোধী মনোভাবকে পুঁজি করতে পারে। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের লুকানো ফাটল উন্মোচিত হয়ে উঠতে পারে তখন।
তিন.
ভারত সরকারের বাংলাদেশনীতি দেখলে মনে হয়, এখানে মোটাদাগে দুটি সমস্যা রয়েছে। প্রথমত, তারা বাংলাদেশের ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাসংগ্রামে ভারতের অকুণ্ঠ সমর্থনকে শুধু একপক্ষীয়ভাবে বিবেচনা করে থাকে।
স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ভারতকে অনেক সুবিধা দিয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন না হলে ভারত তার দুই পাশে পাকিস্তানকে রেখে কখনোই আজকের অবস্থানে আসতে পারত না। এটি মনে রাখলে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক হওয়া উচিত ছিল ভারসাম্যমূলক।
তারপরও আমি মনে করি, দুই দেশে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ আছেন। তাঁরা নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন যে ভারত-বাংলাদেশের প্রকৃত বন্ধুত্বই দুই দেশের জন্য সবচেয়ে মঙ্গলজনক। এমন মানুষ রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রাধান্য পেলে দুই দেশের জনগণ পর্যায়ে দূরত্বও কমবে।
আসিফ নজরুল: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক।