একটি কুচক্রীমহল কর্তৃক মুসলমান শাসনকালকে কলংকৃত করার জন্য ১২০১ থেকে ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ১৫০ বছর সময়কালকে বাংলা সাহিত্যের অন্ধকার যুগ হিসেবে চিহ্নিত করেন। তারা এ যুগে মুসলমান ও তুর্কি আক্রমনের কারণে কবি-সাহিত্যিকগণ ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে থাকতেন। এবং এ কারণেই কবি-সাহিত্যিকগণ উল্লেখযোগ্য কোন সাহিত্য রচনা করতে পারেননি। তবে বাংলা সাহিত্যে অন্ধকার যুগের অস্তিত্ব নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তবে এটাকে অন্ধকার যুগ বলার কোনো অবকাশ নাই। অনেক পণ্ডিতই অন্ধকার যুগকে স্বীকার করেন না।

ড. মুহাম্মদ এনামুল হকের ভাষায় বাংলা সাহিত্যের তুর্কিযুগ প্রধানত ভাষা গঠনের কাল। বাঙ্গালীর মন এ সময়ে আত্মপ্রকাশের পথ খুঁজেছে নদীর ধারার মতো এঁকে-বেঁকে। নিজের পথ নিজের ভাষার খাতে কেটে চলেছে। বাংলা সাহিত্যে তুর্কি বিজয়ের প্রভাব সম্পর্কে ড. আহমদ শরীফ এর মূল্যায়ন- তুর্কীর ধর্ম, মনন ও সংস্কৃতির প্রভাবে যে নতুন চিন্তা চেতনার লাবণ্য এ দেশে দেখা গেল তা ছিল ব্যাপক ও গভীর-ভক্তিবাদ, সন্ত ধর্ম-প্রেমবাদ তারই প্রসুন। তাতে বিজ্ঞান, জ্ঞান, বুদ্ধি ও উচ্চমার্গের তাত্ত্বিক চেতনা ছিল, ছিল মানবতার ও সংবেদনশীলতার স্নিগ্ধতা। সেদিন নিজিত-নিপীড়িত নির্বিত্ত নিম্নবর্ণের মানুষের মনে মুক্তি আক্ষা ও দ্রোহের সাহস জাগিয়ে ছিল। ফলে মানুষের জীবনে জীবিকায় উন্মুক্ত হলে৷ সম্ভাবনার অসীম দিগন্ত। তুর্কী প্রভাবে দেশী মানুষের চিন্তা চেতনায় যে বিপ্লব এলো তাতে ভারতীয় জীবন জিজ্ঞাসায় ও জগত ভাবনায় যুগান্তর ঘটিয়েছিল।

ড. আহমদ শরীফ এযুগের উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম হল রামাই পণ্ডিতের শূন্যপুরাণ ও হলায়ুধ মিশ্রের ‘সেক শুভদয়া’ ১২০১ থেকে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালকে বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগ হিসেবে ধরা হয়। মধ্যযুগের সাহিত্য ছিল ধর্মকেন্দ্রিক। অর্থাৎ ধর্মীয় আবেশে এযুগে সাহিত্য রচিত হত। ফলে এ যুগের সাহিত্যে দেব-দেবীর প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়। এছাড়া এযুগের সাহিত্য ছিল প্রধানত পদ্য ও গীতি নির্ভর। গদ্য সাহিত্য তখনও প্রসার লাভ করে নি বা পরিচিতি পায় নি।

১২০৪ সালে ইখতিয়ার উদ্দীন মুহম্মদ বখতিয়ার খলজি কর্তৃক নদীয়া বিজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলায় মুসলিম শাসনের গোড়াপত্তন হয়। পুঁথি সাহিত্য বলতে ইসলামী চেতনা সম্পৃক্ত সাহিত্যকে বোঝায়। আঠারো থেকে উনিশ শতক পর্যন্ত আরবি, উর্দু, ফারসি ও হিন্দি ভাষার মিশ্রণে রচিত এক শ্রেণির বাংলা সাহিত্যের নাম পুঁথি। এ সাহিত্যের অধিকাংশ রচয়িতা এবং পাঠক উভয়েই ছিল মুসলমান সম্প্রদায়ের। একসময় বাংলায় সন্ধ্যা নামলেই বসত পুঁথি পাঠের আসর। সপ্তদশ শতকে বাংলা সাহিত্যের ব্যাপক প্রসারে আরকান বিশেষ অবদান রাখে। বার্মার অন্তর্ভুক্ত ‘মগের মুল্লুক’ -এ আরকানের বৌদ্ধ রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা অনুবাদ সাহিত্যের বিকাশ সাধিত হয়। বাংলা সাহিত্যে আরকানকে “রোসাঙ্গ” বলা হয়।

আরাকান রাজসভার আদি কবি ও প্রথম বাঙালি কবি দৌলত কাজী। তিনি লৌকিক কাহিনীর প্রথম রচয়িতা। আরাকান রাজসভার শ্রেষ্ট কবি আলাওল। আরাকান রাজসভায় বাংলা সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য সাহিত্যিক- দৌলত কাজী, আলাওল, কোরেশী মাগন ঠাকুর, মরদন, আব্দুল করিম খোন্দকর।

বাংলা সাহিত্যের প্রথম মুসলিম কবি ও রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান ধারার প্রথম কবি শাহ মুহম্মদ সগীর। তিনি ফারসি কবি ফেরদৌসির ‘শাহনামা’ কাব্য অবলম্বনে ‘ইউসুফ-জোলেখা’ কাব্য রচনা করেন। এ কাব্যের পটভূমি ইরান। উল্লেখ্য আব্দুল হাকিম, ফকির গরিবুল্লাহ, ফকির মুহম্মদ প্রমূখ পৃথকভাবে ‘ইউসুফ-জোলেখা’ কাব্য রচনা করেছেন।

ফারসি কবি জামির ‘লায়লা ওয়া মাজনুন’ কাব্যের ভাবানুবাদ রচনা করেন । দৈলত উজির বাহরাম খান।
মুসলমান কবিগণ বাংলা সাহিত্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান রচনায়। মুসলমান কবিদের রচনাতেই প্রথম মানুষ প্রাধান্য পায়।

চতুর্দশ শতকের শেষে ও পঞ্চদশ শতকের শুরুতে শাহ মুহম্মদ সগীর রচিত ‘ইউসুফ- জোলেখা’ কাব্যের মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্যে রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান রচনার সূচনা করা হয়।

পুঁথি সাহিত্য পুঁথি সাহিত্য বলতে ইসলামী চেতনা সম্পৃক্ত সাহিত্যকে বোঝায়। আঠারো থেকে উনিশ শতক পর্যন্ত আরবি, উর্দু, ফারসি ও হিন্দি ভাষার মিশ্রণে রচিত এক শ্রেণির বাংলা সাহিত্যের নাম পুঁথি। এ সাহিত্যের অধিকাংশ রচয়িতা এবং পাঠক উভয়েই ছিল মুসলমান সম্প্রদায়ের। একসময় বাংলায় সন্ধ্যা নামলেই বসত পুঁথি পাঠের আসর।

মধ্যযুগের ধর্মভিত্তিক সাহিত্যধারা থেকে মুসলিম কবিরাই প্রথম পুঁথি সাহিত্যের মাধ্যমে সাহিত্যকে নিয়ে আসেন মানুষের কাছে। তারা তুলে ধরেন মানুষের প্রেম, দুঃসাহসিক অভিযান, অনুভূতির অনাবিল উচ্ছ্বাস।
দোভাষী পুঁথি রচয়িতাদের শায়ের বলা হত। ‘শায়ের’ আরবি শব্দ যার অর্থ কবি। মূলত মুসলমান সমাজের শায়েরগণ ‘দোভাষী পুঁথি’ রচনা করতেন। শায়েরদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- ফকির গরীবুল্লাহ, সৈয়দ হামজা, মোহাম্মদ দানেশ, মালে মুহম্মদ, আব্দুর রহিম, আয়েজুদ্দিন, জনাব আলী, মনিরুদ্দিন, মুহম্মদ খাতের, মুহম্মদ মুনশী প্রমুখ। পুঁথি সাহিত্যের প্রাচীনতম কবি সৈয়দ হামজা এবং প্রথম সার্থক ও জনপ্রিয় কবি ফকির গরীবুল্লাহ।

মধ্যযুগের অন্যতম প্রধান কবি আব্দুল হাকিমের স্বদেশের এবং স্বভাষার প্রতি ছিল অটুট ও অপরিসীম প্রেম। সেই যুগে মাতৃভাষার প্রতি এমন গভীর ভালোবাসার নিদর্শন ইতিহাসে এক বিরল দৃষ্টান্ত এবং পরবর্তী প্রজন্মের জন্য কালজয়ী আদর্শ। নূরনামা তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ। তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ হলোঃ ইউসুফ জুলেখা, লালমতি, সয়ফুলমুলক, শিহাবুদ্দিননামা, নসীহৎনামা, কারবালা ও শহরনামা। তাঁর কবিতায় অনুপম ব্যক্তিত্বের পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি ১৬৯০ সালে মৃত্যুবরণ করেন। বাংলা ভাষার বিকাশে তাঁর অবদান চিরস্মরণীয়। মধ্যযুগের মুসলিম কবিগণে মুসলিম জাতীয়তাবাদের বিকাশের আলোকে আধুনিকালের স্বাধীকারের চেতনার মাধ্যমে সার্বভৌম রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যদিয়ে বাংলা ভাষার আন্তর্জাতিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়।
লেখকঃ মোঃ মোস্তফা মিয়া, অধ্যক্ষ ও কলামিস্ট।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here