সিলেটের মহসীনঃ আব্দুল করিম


যুগে যুগে জ্ঞান ও শিক্ষার দ্বারা পৃথিবীকে যারা আলোকিত করে গেলেন, যাদের জ্ঞান ও প্রতিষ্ঠার সবকিছুই সমাজের জন্য ব্যয় হলো তাদের সংখ্যা হাতে গোনা যায়। এমনি একজন ব্যক্তিত্ব শিক্ষাবিদ মৌলভী আব্দুল করিম।

সারাজীবন তিনি শুধু দিয়েই গেছেন পাওয়ার হিশেব-নিকেশ কোনোদিন করেননি। বহু ভাষাবিদ এই পণ্ডিত উনবিংশ শতাব্দীর এক অন্যতম ১৮৬৩ সালের ২০ আগষ্ট জালালাবাদের কৃতিসন্তান (বর্তমান সিলেট জেলা) পাঠানটুলা নামক এলাকায় মৌলভী আব্দুল করিম জন্মগ্রহণ করেন।

তিনি হযরত শাহজালাল (রঃ) ৩৬০ আউলিয়ার অন্যতম সাথী শাহখিযির কুরায়েশী ইয়ামনির বংশধর বলে কথিত। তার পিতা মুহাম্মদ নাদির ও মাতা – রেওয়ান বিবি। নিজ বাড়িতে আব্দুল করিমের প্রথম শিক্ষা জীবন শুরু হয়। পরে তাকে রাসবিহারী দত্ত স্কুলে ভর্তি করা হয়। স্কুলটি ছিল সিলেট শহরের চৌহাট্টায়। সে সময় স্কুলটি ছিল সিলেটের একমাত্র ইংরেজি স্কুল।

কিছুকাল সেখানে পড়াশুনা করার পর পুনরায় ভর্তি হন সিলেট সরকারি উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে। এবং সেখান থেকে তিনি ফারসী ভাষাকে দ্বিতীয় ভাষা নিয়ে প্রবেশিকা পরীক্ষা পাশ করেন। পরে উচ্চ শিক্ষার জন্য ভর্তি হন কোলকাতার প্রেসিডেন্সী কলেজে। অসাধারণ প্রতিভা ও অধ্যবসায়ের

ফলে তিনি ১৮৮৬ সালে কৃতিত্বের সহিত ইংরেজিতে বি.এ. (অনার্স) পাশ করেন। তিনিই বৃহত্তর সিলেটের প্রথম মুসলিম অনার্স গ্রাজুয়েট। ১৮৮৬ সালে তিনি কোলকাতার আলীয়া মাদ্রাসা ইঙ্গ ফরাসি বিভাগের শিক্ষক হিশেবে কর্মজীবনে পা দেন।

১৮৮৯ সালে তিনি সহকারি পরিদর্শক (মুসলিম) নিযুক্ত হন। দীর্ঘ চার বৎসর চাকুরী করার পর ১৮৯০ সালে তিনি ঢাকা বদলী হয়ে আসেন এবং সেখানে আরও চার বৎসর কাজ করার পর পুনরায় ১৮৯৫ সালে কোলকাতায় ফিরে যান।

সেখানে আরও পাঁচ বৎসর কাজ করার পর ১৯০০ সালে পাটনায় চলে আসেন। পারটনায় এক বৎসর কাজ করার পর পুনরায় পদোন্নতিসহ ১৯০১ সালে চট্টগ্রামে বদলী হয়ে আসেন। সেখানে তিনি সামান্য দিন কাজ করার পর পুনরায় ঐ বৎসর তিনি ঢাকায় ফিরে আসেন এবং একটানা ১৯১২ সাল পর্যন্ত ঢাকায় চাকুরী করেন। ১৯১৪ সালে তিনি সরকারি চাকুরী থেকে অবসরগ্রহণ করেন।

তিনি বাংলা ভাষায় শিক্ষাদানের পক্ষপাতি ছিলেন। ইংরেজি শিক্ষার ব্যাপারেও তার আগ্রহ ছিল। তবে বাংলা ভাষায় শিক্ষাদান চালু এ ব্যাপারে তার অবদান চাকুরীকালিন সময়ে তিনি যে সব বরেণ্য লোকের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন তারা হলেন জাষ্টিস সায়্যিদ আমীর আলী, নওয়াব বাহাদুর আব্দুল লতিফ, নওয়াব আলী চৌধুরী, মাহমুদ আলী খান পন্নী, ব্যারিষ্টার আব্দুর রসুল, মৌলভী ওয়াজিদ আলী, নওয়াব মুয়ায্যম হােসেন, মৌলভী আসীরুদ্দীন, নওয়াব হোসসাম হায়দার চৌধুরী প্রমুখ। চাকুরি জীবনে তিনি বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন ও রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পরেন।

১৮৯৯ সালের ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত All India Muhammedan Educational Conference-9 fa a P ও ১৯০৬ সালের ২৭শে ডিসেম্বর ঢাকার শাহবাগে অনুষ্ঠিত ২০তম অধিবেশনে তিনি তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ১৯০৬ সালের ১৪ ও ১৫ই এপ্রিল পূর্ববঙ্গ ও আসাম মুসলমান শিক্ষা সমিতির গ্রাম অধিবেশন ঢাকার

শাহবাগ উদ্যানে অনুষ্ঠিত হয় তাতেও তিনি উপস্থিত ছিলেন। ১৯০৬ সালের ২৭শে ডিসেম্বর ঢাকার শাহবাগে অনুষ্ঠিত পূর্বোক্ত সভায় সিলেট থেকে ১৫ জন সদস্য ও ৬ জন দর্শক উপস্থিত ছিলেন। ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠার সাথেও তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি মাদ্রাসা সংস্কার কমিটির সদস্য ছিলেন।

১৯১৫ সালে আব্দুল করিম বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির সভাপতি নিযুক্ত হন। তিনি আঞ্জুমান-ই-ইসলাহল মুসলিমীন এর প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারী। আব্দুল করিম মোহামেডান এডুকেশনাল কনফারেন্সেরও প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ১৯১৬ সালে মালদহ্ ও বর্ধমানে অনুষ্ঠিত শিক্ষা সম্মেলনে তিনি সভাপতিত্ব করেন। এ ছাড়াও ১৯১৯ সালের অক্টোবর মাসে অনুষ্ঠিত সিলেট মুসলিম ছাত্র সমিতির শিক্ষা সম্মেলনেও তিনি সভাপতিত্ব করেন।

আব্দুল করিম দীর্ঘকাল বঙ্গীয় মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। অবশ্য মধ্যে তিনি একবার ভাইস-প্রেসিডেন্ট ছিলেন। পুনরায় তিনি মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট হন এবং ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত উক্তপদে অধিষ্ঠিত থাকেন। ১৯২৪ সালে লাহােরে তিনি নিখিল ভারত মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য পদ লাভ করেন। ঐ বৎসর ডিসেম্বরে বোমে সেশনে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গঠিত একটি কমিটির সদস্য পদও তিনি লাভ করেন।

১৯২৮ সালের জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত মুসলিম লীগের কোলকাতা অধিবেশনে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহকে পরবর্তী তিন বৎসর সভাপতি হিশেবে নির্বাচনের উক্ত সংগঠনের ২০তম বার্ষিক অধিবেশনের অভ্যর্থনা কমিটির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তিনি।

১৯৩০ সালে গোল টেবিল কনফারেন্সে বঙ্গীয় মুসলিম ডেলিগেটদের সভা উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে তিনি সভাপতিত্ব করেন। তিনি ১৯৩১ সালে কোলকাতার অল ইন্ডিয়া মুসলিম কনফারেন্স অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি ছিলেন।

খেন তিনি। ১৯২৮ সালের ডিসে্রে ১৯৪৩ সালের নভেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগ সেশনে তিনি

কৃষকদের দুর্দশা লাঘবের উপর গুরুত্ব আরােপ করেন। ১৯২৪ সালে তিনি পূর্ববঙ্গীয় নির্বাচনী এলাকা থেকে ষ্টেট কাউন্সিলের সদস্য নির্বাচিত হন।

১৯২৬ সালে তিনি বর্ধমান বিভাগ থেকে বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য হয়ে ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত কাজ করে যান। ১৯৩৭ সালে তিনি বেঙ্গল মুসলিম কনফারেন্সের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। মুসলমানদের শিক্ষার উন্নতির বিধানের লক্ষ্যে আব্দুল করিম কোলকাতাস্থ তার দু’টি বাড়ি দান করে যান। এ সম্পর্কে লাহোর থেকে

1 Light fa – ‘Had made a waqf of Rs. 50,000/00 the proceeds of which are to be spent on the education of the poor, on the relief of one orphans & widows and on ishaate Islam, here is an oldman who should serve as a model.”

অধ্যাপিকা উদ্মে সালমা লিখেছেন।

‘As President of the Bengal Provincial Muslim League he played an important part in the movement for independence and in the upliftment of Muslim society of Bengal during 1920’s 1930’s.

আব্দুল করিম সাংবাদিকতার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি কোহিনুর (১৮৯৮) পরিচালক সমিতির সদস্য ছিলেন। তিনি ‘দরুল সুলতানাত নামক উর্দু পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে তার অবদানের কমতি ছিল না। ১৮৯৫ সালের ১৫ আগষ্ট মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব ও ডায়মন্ড জুবিলী রিডিং ক্লাবের যৌথ উদ্যোগে ও ৬ নং ওয়ালিউর লেনের (কোলকাতা) বাড়িতে একটি ডিবেটিং ক্লাবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেও তিনি সভাপতিত্ব করেন।

আব্দুল করিম বাংলা, হিন্দি, আরবী ও ইংরেজি ভাষায় বহু পুস্তক রচনা করেন। তন্মধ্যে বাংলা, ইংরেজি, উর্দু ও হিন্দি ভাষায় ভারতবর্ষের ইতিহাস উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়াও রয়েছে – দান”, ‘ইসলামের পয়গম্বর ও তার শিক্ষা”, ‘সার্বজনীন প্রগতির ধর্ম ইসলাম।

আব্দুল করিম প্রণীত প্রথম বাংলা গ্রন্থ উনিশ শতকে বাঙালী মুসলমানের চিন্তা চেতনার ধারা গ্রন্থটি সেন্টকাফ প্রেস, কোলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়। ঢাকা প্রকাশ ২৩ শ্রাবণ ১৩০৫ বাংলা ১৯০০ সালে কোলকাতায় অনুষ্ঠিত মোহামেডান এডুকেশনাল কনফারেন্সের জন্য তিনি “Muhammedan Education in Bengal f I আব্দুল করিম বি.এ. (অনার্স) পাশ করার পর আয়েশা খাতুন নামকগুণবতী এক মহিলাকে বিয়ে করেন। মহিলার পিতা মৌলানা হাফেজ মুহাম্মদ হাতেম। তিনি সেকালের একজন বিখ্যাত দরবেশ ছিলেন।

মুসলিম রেনেসাঁর অগ্রদূত এবং পাক ভারতের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ আব্দুল করিম ১৯৪৩ সালের ৩রা আগষ্ট ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিলো ৮০ বৎসর।মহৎ লোকের জীবনী মানুষকে মহৎ হওয়ার অনুপ্রেরণা যোগায়। আব্দুল করিম ছিলেন একজন মহৎ লোক।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *