১। বাংলাদেশে এখন মোট ১২ টি ক্যাডেট কলেজ রয়েছে, যেগুলো দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। মেধাবী তরুণদের সুশিক্ষিত ও সুযোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে পালন করে যাচ্ছে অনন্য ভূমিকা। স্বাধীনতার পূর্বে চারটি ক্যাডেট কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়। যে গুলো হলো- ইস্ট পাকিস্তান ক্যাডেট কলেজ যা বর্তমানে ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ (২৮ এপ্রিল ১৯৫৮), ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ (১৮ অক্টোবর ১৯৬৩), মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ (৯ জানুয়ারি ১৯৬৫) ও রাজশাহী ক্যাডেট কলেজ (১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬)। এ চারটিই প্রতিষ্ঠিত হয় তৎকালীন পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি ফিল্ডমার্শাল আইয়ুব খানের ব্যক্তিগত উদ্যোগে। এ প্রতিষ্ঠানসমূহ আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে অভূতপূর্ব অবদান রেখে যাচ্ছিল। বিশেষ করে সামরিক বাহিনীর চৌকস অফিসার সৃষ্টিতে ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। যাদের অনেকে মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।
২। কিন্তু স্বাধীনতার পরপর দেশ বিরোধী, সামরিক বাহিনীর বিরোধী, কিছু কুচক্রী ও ষড়যন্ত্রকারীদের প্ররোচনা ও কুমন্ত্রনায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান এ ক্যাডেট কলেজ চিরতরে বিলুপ্ত করে সাধারণ কলেজে রূপান্তর করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন ১৯৭২ সালের আগস্ট মাসে রাষ্ট্রপতির ক্যাডেট কলেজ অধ্যাদেশ (Presidential Ordnance) নং ৮৯ এর মাধ্যমে। এ আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত বাতিলে দুঃসাহসিক ভূমিকা পালন করেন স্বাধীনতাযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানী। এ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটিই এখানে সংক্ষেপে তুলে ধরার প্রয়াস।
৩। ১৯৭২ সালের মাঝামাঝি সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত ঐতিহ্যবাহী ক্যাডেট কলেজে ‘ছাত্র রাজনীতি’ চালু করার উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সচিব তোফায়েল আহমেদ ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে যান। কিন্তু দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র আনোয়ারুল হকের নেতৃত্বে মিনু খাদেম, কাইয়ুমুল হুদা, এম এ তারেক ও এম নূরুর রহমান- এ পাঁচজন ক্যাডেট কলেজকে ছাত্র রাজনীতিমুক্ত রাখার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে ছাত্র-শিক্ষক সকলকে ঐক্যবদ্ধ করে তোফায়েল আহমেদের মিটিং-এ যোগদান হতে বিরত রাখেন। ফলে তিনি অপমানিত বোধ করে ব্যর্থ ও নিরাশ হয়ে ফেরত যান। এ ঘটনার ১০ দিনের মাথায় রেডিও, টেলিভিশন ও সংবাদপত্রে সকল ক্যাডেট কলেজ বিলুপ্ত করার সংবাদ পরিবেশিত হয়। এ খবরে সকলে অত্যন্ত ব্যথিত, মর্মাহত হয়ে পড়ে এবং হৃদয়ে রক্তক্ষরণ শুরু হয়।
৪। ইতোমধ্যে ছাত্ররা ক্যাডেট কলেজসমূহ বাঁচিয়ে রাখার সর্বাত্মক সংগ্রাম বা চেষ্টা বজায় রেখে অগ্রসর হতে থাকেন। প্রাক্তন ও বর্তমান ক্যাডেট সকলে সম্মিলিত ভাবে ‘কিপ ক্যাডেট কলেজেস্ ক্যাম্পেইন’ (Keep Cadet Colleges Campaign) নামের আন্দোলনে অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ ভাবে অগ্রসর হতে থাকে। এর নেতৃত্ব দিতে থাকেন পূর্বে বর্ণিত পাঁচজন ছাত্র। হন্যে হয়ে ঘুরতে থাকেন তাঁরা। বিভিন্ন স্থানে যোগাযোগ করে এ তরুণরা যখন কোন আশার আলো দেখতে পাচ্ছিল না, তখন হঠাৎ করে দেখা মিলে চতুর্থ ব্যাচের ফৌজিয়ান চৌধুরি এম মহসিনের। তাঁর পরামর্শ অনুযায়ী তৎকালীন ব্রিগেডিয়ার জিয়াউর রহমানের (পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি) সাথে দেখা করলে তিনি বলেন, ‘জেনারেল ওসমানী না পারলে ক্যাডেট কলেজের বিলুপ্তি কেউ ঠেকাতে পারবে না’। তিনি জেনারেল ওসমানীর সাথে তাদের সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দেন।
৫। অতঃপর তাঁরা জেনারেল ওসমানীকে (তখন নৌ-পরিবহণ মন্ত্রী) পুরো বিষয়টি খুলে বললে তিনি সরকারি এ সিদ্ধান্তে খুবই মর্মাহত ও মনোক্ষুন্ন হন এবং বঙ্গবন্ধুকে ফোন করে জানতে চান, ‘ক্যাডেট কলেজ বিলুপ্ত করার পরামর্শ তাঁকে কে দিয়েছে, তাঁর অগোচরেই কিভাবে ক্যাডেট কলেজ বিলোপের মতো কাজটি সম্পাদিত হল?’ তিনি দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনী ও শিক্ষা ব্যবস্থায় ক্যাডেট কলেজের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুকে বুঝাতে চেষ্টা করেন ও বিলুপ্তির ‘পিও’টি বাতিল করার জন্য অনুরোধ করে বলেন, ‘ক্যাডেট কলেজ থাকলে আমি থাকবো, অন্যথায় পদত্যাগ করবো’ (If Cadet Colleges stay, I stay, otherwise I resign.’ এরপর জেনারেল ওসমানী বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করে একান্তে কথা বলে তাঁকে বুঝাতে সক্ষম হন এবং বঙ্গবন্ধু ক্যাডেট কলেজ বিলুপ্তির ‘পিও’ বাতিলের নির্দেশ দেন। ফলে ক্যাডেট কলেজ ফিরে পায় শয়তানী চক্রের হাতে বিলুপ্ত হওয়া ‘প্রাণ’। মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক তাঁর সৌম্য, শক্তি, ক্ষিপ্রতা, তেজস্বীতা, তীক্ষ্ন বুদ্ধিমত্তা, নিখাঁদ দেশপ্রেম ও অসাধারণ সাহসীকতার মাধ্যমে দেশরক্ষার মতো দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকেও রক্ষা করলেন অনিবার্য এক বিপর্যয়ের হাত থেকে। তাই ‘বঙ্গবীর’ খেতাবের পাশাপাশি ওসমানী চিরদিন অমর হয়ে থাকবেন বাংলাদেশের ক্যাডেট কলেজের ‘জনক’ হিসেবে। আর দেশ ও জাতি চিরঋনি ও চিরকৃতজ্ঞ হয়ে থাকলো এ মহান ও সর্বস্য ত্যাগী নেতার নিকট।
(সুত্র: মেজর জেনারেল সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বীর প্রতীক লিখিত বই ‘মিশ্রকথন’ ও Minoo Khadem লিখিত `Keep Cadet College Campaign’ প্রবন্ধ অবলম্বনে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here