আমার বড় ছেলে পিতম, ওর ভালো বন্ধু ব্রায়ান, জোসেফ ও এড্রিন। ওদেরকে আমি অনেক বছর ধরে চিনি। কিন্ডারগার্টেন থেকে ওরা একসঙ্গে পড়াশোনা করে আসছে। এখন ওরা হাইস্কুলে পড়ে। ওদের বন্ধুতা ঈর্ষণীয় রকমের উপভোগ্য হয়ে উঠেছে আমার কাছে। তিনজনই একসঙ্গে এখন ব্রক্সস সায়েন্সে পড়ে। স্কুল থেকে বিভিন্ন সময়ে শিক্ষামূলক সফরে তারা একসঙ্গে গেছে, পাশাপাশি রুমে থেকেছে। সেসব গল্প ফিরে এসে আমাকে বলেছে। আমি শুনে প্রফুল্ল বোধ করেছি। স্কুলের ক্লাবগুলোতে ওরা একসঙ্গে যায়, ক্লাসওয়ার্ক করে মিলেমিশে।

স্কুল ছুটির দিনে মাঝেমধ্যে পিতমের বন্ধুরা আমার বাসায় বেড়াতে আসে, পিতমও তাদের বাসায় যায় অবসর সময় কাটাতে। ওরা যখন আমার বাসায় এসে লিভিং রুমে বসে গল্প করে, ঘরের আলো নিভিয়ে দিয়ে মুভি দেখে, তখন আমি নস্টালজিক হয়ে পড়ি ওদের দেখে।

ব্রায়ান, জোসেফ, এড্রিন ভিনদেশি হলেও আমি ওদের মচমচে পরোটা ভেজে খেতে দিই রসগোল্লার সঙ্গে। ওরা আমার হাতের রান্না তৃপ্তি সহকারে খায় খাবার টেবিলে বসে। আমি ওদের মুখের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকি আর ভাবি, কে বলবে ওরা ভিনদেশি? ভিন্ন ধর্মাবলম্বী? ভিন্ন সংস্কৃতির কেউ? অথচ, ওদের বয়সী থাকার সময় দেখেছি মুসলমানরা হিন্দৃুদের রান্নাঘর, হিন্দুরা মুসলমানদের রান্নাঘর ঘর এড়িয়ে চলতে। এক কথায় ধর্মীয় গোঁড়ামি, কুসংস্কার নিয়ে বড় হয়েছি আমরা অনেকেই। পিতমকেও দেখেছি অনেক সময় তার বন্ধুদের বাসায় দুপুর, রাতের খাবার খেয়ে বাসায় ফিরেছে। আমাদের ছোট বাচ্চাদের মধ্যে মানবধর্মের চারাগাছ ফুলে- ফলে প্রস্ফুটিত হতে দেখলে, বুকের গহিনে শান্তির ফোয়ারা বয়ে যায়।

করোনাভাইরাস আতঙ্কে আমেরিকার স্কুল, কলেজ, উপাসনালয়সহ প্রায় সব প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে পড়েছে। শুধু আমেরিকা নয়, গোটা বিশ্ব অদৃশ্য অণুজীব করোনাভাইরাসের আধিপত্যের কাছে মুখ থুবড়ে পড়েছে। মানুষ আলাদা হয়ে পড়েছে মানুষ থেকে। এর মধ্যেও লক্ষ করলাম ফোন কল, ভিডিও কলে পিতম সার্বক্ষণিক তার বন্ধুদের সঙ্গে সংযুক্ত রয়েছে। একদিন বন্ধুর বাসায় যাওয়ার অনুমতি না দেওয়ায় আমার ওপর অসন্তুষ্ট হয়েছে। বুঝিয়ে বলার পরে বুঝেছে। বলেছে, আর ওদের বাসায় যাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করবে না।

একদিন হঠাৎ এসে পিতম বলল, এড্রিনের বাসায় যাবে। জানতে চাইলাম এত বলে বোঝানোর পরেও এমন জরুরি অবস্থায় কেন যাবে? উত্তরে বলল, এড্রিনের বাসায় প্রার্থনা হবে, সে প্রার্থনায় যোগ দিতে চায়। যুগ যুগ ধরে নিজের মধ্যে লালন করা অভ্যাসগত ধারণার বশবর্তী হয়ে বললাম, ‘ওরা খ্রিষ্টান। ওদের ধর্মীয় নিয়মানুযায়ী ওরা প্রার্থনা করবে। তুমি সেখানে গিয়ে কী করবে? নিজের বাসায় থেকে তুমি নামাজ পড়ো, সবার জন্য দোয়া করো।’

উত্তরে পিতম বলল, ‘আম্মু এড্রিন খ্রিষ্টান হলেও ওর বাসার প্রার্থনায় পৃথিবীর সব ধর্মের মানুষের জন্য দোয়া করা হবে। আমার আরেক মুসলমান বন্ধুও থাকবে। যে যার ধর্মমতো প্রার্থনা করবে। সেখানে ধর্মীয় নিয়মানুযায়ী মানুষের জন্য প্রার্থনা করব আমরা, কোনো বিশেষ ধর্মের জন্য নয়।’

পিতমের কথা শুনে নিজের মানসিক হীনম্মন্যতা, নিচুতার জন্য লজ্জা পাই। ওদের গভীর ভাবনা ও মানবতাবোধের কাছে চুপসে পড়ি। আমি চুপ হয়ে রই।

দুু-এক মাস আগের কথা। দিল্লিতে মুসলমান-হিন্দুদের মধ্য দাঙ্গা চলছে। নৃশংস অত্যাচার চালানো হচ্ছে মুসলমানদের ওপর। ঠিক সে সময়ে আমার মেয়ের স্কুলের এক সিনিয়র ছাত্রী খুকু রানী আমাকে ফোন করেছিল। খুকু রানী দ্য হাইস্কুল অব ব্রক্সস সায়েন্সের মিস্ট (MIST) ক্লাবের সভাপতি। আমার মেয়েও মিস্টের সদস্য। মিস্ট ক্লাবের পক্ষ থেকে তারা নানান সেবামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে।

খুকু আমাকে জানায়, তারা ম্যানহাটনের ইউনিয়ন স্কয়ারে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে, যে অনুষ্ঠানের মূল লক্ষ্য হলো মানবসেবা। ওই অনুষ্ঠানে তারা ক্লাবের পক্ষ হতে মানুষের হাতে মেহেদির আল্পনা এঁকে দেবে। তার বিনিময়ে যে অর্থ পাবে সে অর্থ তারা বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া অসহায় রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য পাঠাবে। উল্লেখ্য, দ্য হাইস্কুল অব ব্রক্সস সায়েন্সের বেশির ভাগ ছাত্রছাত্রী এশিয়ান। তাদের এক মিয়ানমারের বন্ধুর মুখে শুনেছে রোহিঙ্গাদের করুণ জীবনযাপনের কথা।

বন্ধুর মুখে শুনে সিদ্ধান্ত নেয় তাদের পাশে দাঁড়ানোর। স্কুল ছুটির দিন শনিবারে আমি যেন আমার মেয়েকে ওই অনুষ্ঠানে যাওয়ার অনুমতি দিই, সেজন্য খুকু রানী অনুমতি চেয়ে আমাকে কল করেছিল। পৃথিবীর এক প্রান্তে যখন কিছু উগ্র, মানুষ ধর্মকে পুঁজি করে মুসলমানদের ওপর বর্বর হামলা চালাচ্ছিল, ঠিক তখন পৃথিবীর অন্য প্রান্তে একজন পরিচ্ছন্ন মনের মানুষ, মানব ধর্মে দীক্ষিত খুকু রানী মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশ থেকে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া মুসলিম রোহিঙ্গাদের জন্য অর্থ সংগ্রহে ছুটির দিনেও নিরলসভাবে পরিশ্রম করে চলছে। কোনো বিশেষ ধর্ম নয়, মানবধর্মের জয় দেখেছি আমি সেদিন ওদের মাঝে।

আমার ছাত্রজীবনের কথা। আমার পাশের রুমেই থাকতেন হলের সিনিয়র অনামিকা সাহা দিদি। তাঁকে দেখলেই আমার রজনীগন্ধা ফুলের কথা মনে পড়ত। ভাবতাম, মানুষ এত শুভ্র সুন্দর হয় কেমন করে! হোস্টেলের বারান্দায় দুপুরের রোদে লম্বা চুল শুকাতে দিয়ে উনি যখন বই পড়তেন, তখন মনে হতো আকাশের আনাচ-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মেঘেরা সরে গিয়ে সোনালি রোদ আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।

মিষ্টভাষী অনামিকাদি আমাকে খুব আদর করতেন। বিকেলে রুমে ডেকে নিয়ে চা, ডালপুরি খেতে দিতেন। ভারি মিষ্টি গানের গলা ছিল তাঁর। মাঝেমধ্যে আবৃত্তি করেও শোনাতেন। শুধু আমি নয়, আমাদের হোস্টেলের প্রায় সবার পছন্দের মানুষ ছিলেন অনামিকাদি। হলের মেয়েদের জন্য উদার ছিলেন, যে কারও প্রয়োজনে পাশে দাঁড়াতেন।

প্রাণোচ্ছল অনামিকাদির চাঁদমুখ আচমকা ফ্যাকাসে হয়ে যেতে দেখি। তাঁর মধ্যে ভালোলাগার উজ্জ্বলতা নেই, তাঁর হৃদয়ের ওমে আশ্রয় নেওয়া আমি হঠাৎ সেখানে কোনো উত্তাপ খুঁজে পাই না। দিনদিন তাঁর মুখের সোনালি আলো ক্রমেই হলুদ হয়ে আসতে দেখে খবর নিয়ে জানতে পারি, মুসলমান এক ছেলের সঙ্গে তাঁর প্রণয়ের কথা। যে কথা দিদির পরিবারে জানাজানির পর তাঁর ওপর অত্যাচারের খড়গ নেমে আসে। জোর করে তাঁকে বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁর গতিবিধির ওপর পরিবারের পক্ষ থেকে কড়া নজর রাখা হয়।

পরিবারের খবরদারিতে তাঁর স্বাভাবিক জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। দিদি হল ছেড়ে চলে যান আপন নিবাসে। পরে কী হয়েছিল আমি আর জানতে পারিনি। দিদি আর কোনো দিন হলে ফিরে আসেননি, তাঁকে কলেজেও দেখিনি। অনেক বছর পেরিয়ে আজ মনে হয়, ধর্ম থামিয়ে দিয়েছিল একজন হাসিখুশি মানুষের হৃদস্পন্দন, কেড়ে নিয়েছিল স্বাভাবিক জীবনের গতি। হয়তো ধর্মের জাঁতাকলে হারিয়ে গেছেন অনামিকা দিদি চিরদিনের জন্য।

দীর্ঘ শীতনিদ্রা ভেঙে নিউইয়র্কের প্রকৃতিতে এখন বসন্তের হাওয়া বইছে। বাড়ির আঙিনায়, পথের ধারে রং–বেরঙের কত জান-অজানা ফুল ফুটে আছে। যত দূর চোখ যায়  ফুল, পাখি, মৃদু হাওয়া, সবুজের হাতছানিতে মন আবেশিত হয়ে ওঠে। কি সুন্দর পৃথিবী! কিন্তু মানুষ ছাড়া এই সুন্দর পৃথিবী, পথঘাট, ফুল, পাখি, বসন্ত হাওয়া, সবুজ প্রকৃতি সবকিছু অর্থহীন লাগে। জানালার পাশে গিয়ে যখন বাইরে তাকাই, বুকে হাহাকার জাগে। চারপাশ ফাঁকা। করোনাভাইরাসের বিস্তার কমাতে, সংক্রমণ এড়াতে মানুষ পথঘাট ছেড়ে ঠাঁই নিয়েছে নিরাপদ আশ্রয়ে। করোনাভাইরাসের আতঙ্কে জনজীবন থেমে আছে।

বোধজ্ঞান হওয়ার পর থেকে ধর্ম নিয়ে মানুষের মধ্যে বিরোধ দেখেছি, শুনেছি। মানুষ মানুষের জন্ম দেয়, আবার ধর্মযুদ্ধে এক মানুষ আরেক মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়। সর্বাবস্থায় স্রষ্টা তাঁর প্রতিটি সৃষ্টির মধ্যে বিরাজমান। অথচ, স্রষ্টার দোহাই দিয়ে এক সৃষ্টি কেড়ে নিচ্ছে আরেক সৃষ্টির প্রাণ। মানুষ মরে গেলে স্রষ্টা বাঁচবেন কার অন্তরে! ধর্ম দেখানো কিংবা বিরোধের বিষয় নয়, ধর্ম অনুভূতির বিষয়। সৃষ্টিকর্তা বাস করেন মানুষের হৃদয়ে। মানুষের হৃদয় স্থান, কাল, পাত্রভেদে কোথায়ও থেমে থাকে না। মানুষ বাঁচলে ধর্ম বাঁচবেই। মানুষ মানুষের জন্য। পৃথিবীতে সবার ওপরে মানবধর্ম। যার ধর্ম সে পালন করবে, ধর্ম নিয়ে হানাহানি একদম অনুচিত।

প্রকৃতির কাছে মানুষ অসহায় এক প্রাণী। করোনাভাইরাস ধর্ম–বর্ণনির্বিশেষে সবাইকে বুঝিয়ে দিয়েছে, তোমরা মানুষ প্রজাতি ধর্ম, বর্ণ নিয়ে হানাহানি কোরো না, সংঘর্ষে লিপ্ত হোয়ো না। তোমরা সব মানুষ এক ও অসহায়। করোনাভাইরাসের আধিপত্যে আজ যখন মাসজিদ, মন্দির, গির্জা সর্বোপরি সব ধরনের উপাসনালয় বন্ধ, তখন সব ধর্মের মানুষ একত্র হয়েছে মানবতার ছায়াতলে। মানুষে মানুষে ধর্মের দোহাই দিয়ে পৃথিবীজুড়ে যে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে, বোধ করি প্রকৃতিও এতে ক্লান্ত হয়ে উঠেছে। প্রকৃতিও যেন পরিত্রাণ চাইছে এই ধর্মযুদ্ধ থেকে।

কখনো কখনো মনে হয়, মানুষকে বাঁচাতে, শান্ত করে তুলতেই প্রকৃতি তাঁদের কিছুদিনের জন্য পাঠিয়েছে ঘরে। ধর্ম নিয়ে সামনের দিনগুলোতে আমরা যেন আর কোনো বিভেদ না দেখি পৃথিবীতে। ধর্মীয় বিভেদে আর কোনো প্রাণ ঝরে না পড়ুক অকালে। বিশৃঙ্খলা নয়, মানবধর্মের মধ্যে সমর্পিত করুক মানুষ নিজেকে। এক মানুষের বিপদে আরেক মানুষ এগিয়ে আসুক। মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সব দুর্দিন কেটে যাক, প্রতিটি প্রাণ হেসে উঠুক, বেঁচে থাকুক নিশ্চিন্তে, আনন্দে। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত পৃথিবী নামক গ্রহটির গভীর বিষণ্ন অসুখ দ্রুত সেরে যাক। সবাই নিরাপদে থাকুন। ভালো থাকুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here