ইংলিশ সিক্স নাম্বারটি আপনার দিক থেকে দেখলে সিক্সই লাগবে, কিন্তু আপনার বিপরীতে দাঁড়ানো আমার দিক থেকে দেখলে সেটাকে নাইন দেখাবে৷ কথা হচ্ছে আলাদা আলাদা পার্সেপশনের। আলাদা আলাদা দৃষ্টিকোণ ও ভিন্ন ভিন্ন চিন্তা-চেতনার।
তুরস্ক সম্প্রতি হাজিয়া সুফিয়া মিউজিয়ামকে মসজিদে রুপান্তরিত করেছে যা এক সময় গীর্জা ছিল৷ পরবর্তীতে ওসমানী সুলতান মুহাম্মদ আল ফাতিহ রাহঃ যখন ইস্তাম্বুল বিজয় করেন তখন বলা হয়, কিছু দলিল আদিল্লাহও পেশ করা হয় যে, তিনি এই গীর্জাটি আশেপাশের আরো কিছু জায়গাসহ ক্রয় করে নেন প্রিস্টদের কাছ থেকে। পরে তা মসজিদ বানান। তবে ক্রয় করেন নাই মর্মেও স্ট্রং ইভিডেন্স আছে। বরং বলা হয় যে, বিজিত অঞ্চল হিসেবে গীর্জাকে মসজিদ বানিয়ে দেন। পরবর্তীতে সেকুলার ও ইসলামের শত্রু বলে পরিচিত কামাল আতাতুর্ক সেই মসজিদকে মিউজিয়াম বানিয়ে দেয়।
ফিকহি দৃষ্টিকোণ থেকে, সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ কথা হচ্ছে, বিজিত এলাকার গীর্জা মসজিদে রুপান্তর করা যায় কীনা এ নিয়ে বিশাল বিতর্ক হতে পারে। পক্ষে বিপক্ষে অনেক দলিল আদিল্লাহ দেয়া যাবে। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং খুলাফায়ে রাশিদিন বিজিত অঞ্চলের গীর্জাকে মসজিদ করেছেন কীনা এ নিয়ে লম্বা বিতর্ক হতে পারে। কাজেই বিষয়টি ফিকহি দৃষ্টিকোণ থেকে একদম যে পরিষ্কার তা কোন পক্ষই হলফ করে বলতে পারবেন না৷
এখন এই ইস্যূটি নিয়ে আমাদের মুসলমান সমাজের অনেকেই পক্ষে বিপক্ষে চরম বাড়াবাড়ি করছেন। যারা মিউজিয়ামকে মসজিদ করার বিপক্ষে, তাদের কথা শুনে মনে হচ্ছে যে, এরদোগান সাহেবই গীর্জাকে মসজিদ বানিয়েছেন। না, বরং তিনি মিউজিয়ামকে আবার মসজিদে পূনঃরুপান্তর করেছেন।
আর সুলতান মুহাম্মদ আল ফাতিহ রাহঃ যদি সত্যিই গীর্জাটি কিনে মসজিদ বানিয়ে থাকেন তবে তিনি জুলুম করেন নি। এটা নিয়ে এত উত্তেজিত হয়ে ইসলামের দিকে আংগুল তোলার কিছু নেই। ইউরোপ আমেরিকাতে আজো শত শত গীর্জা বিক্রি হচ্ছে আর তা মসজিদে পরিণত হচ্ছে।
আবার মসজিদ বানানোর পক্ষের অনেকেও চরম বাড়াবাড়ি করছেন। যারা হাজিয়া সুফিয়া মিউজিয়াম মসজিদ করার বিপক্ষে, তাদেরকে তারা কাফির, মুরতাদ, ইহুদি নাসারার দালাল বলেও গালি দিচ্ছেন। ভাই, ইসলামের ন্যূনতম জ্ঞান থাকলে ও কমন সেন্স থাকলেও এই কারণে কেউ কাউকে কাফির- মুরতাদ বলতে পারেন না। এই বিষয়টি নিয়ে অনেক ইখতিলাফ আছে, পক্ষে বিপক্ষে ঐতিহাসিক অনেক দলিল আছে।
অনেকে মুসলমান এই আশংকা থেকেও বলছেন যে, এই মিউজিয়ামকে আবার মসজিদ করার মাধ্যমে আমরা অমুসলিম জালিম শাসকদের হাতে তাদের দেশে অবস্থিত মসজিদগুলোকে মন্দির গীর্জাতে পরিণত করার দলিল তুলে দিচ্ছি কীনা সেটাও ভেবে দেখা দরকার। সবাই তো হিংসা ও ঘৃণার কারণে বলছে না। কেউ সঠিক বিষয়টি না বুঝার কারণেও বলছে।
বর্ণিত আছে, হজরত ওমর ফারুক রাঃ যখন মসজিদে আকসা নিয়ে আলোচনা করতে জেরুজালে যান, তখন খ্রীষ্টান পাদ্রীদের সাথে আলোচনা হচ্ছিল একটি গীর্জাতে। নামাজের সময় হলে পাদ্রীরা ওমর ফারুক রাঃ কে গীর্জার ভেতরেই নামাজ পড়তে অনুরোধ করলে ওমর ফারুক রাঃ বলেন, না, আমি যদি এই গীর্জাতে নামাজ পড়ি তাহলে ভবিষ্যতে কোন মুসলমান শাসক আমার নামাজ পড়ার ওজুহাতে এই গীর্জা ভেংগে হয়ত মসজিদ করে ফেলবে। আপনাদের অধিকার ক্ষুন্ন হবে। এই ভেবে তিনি গীর্জার বাহিরে খোলা জায়গায় নামাজ আদায় করেন। শোনা যায় সেই জায়গাতে আসলেই মসজিদে ওমর রাঃ নামে একটা মসজিদ নির্মাণ হয় পরবর্তীতে।
আর অনেক মুসলমান ভাই বলছেন, কাবা শরিফ পৌত্তলিকদের ইবাদাতখানা ছিল যা নবি কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কা বিজয়ের পর সব মূর্তি ভেংগে আবার মুসলমানদের জন্য এক্সক্লুসিভ ইবাদাতখানা মাসজিদুল হারামে পরিণত করেন।
ভাই দয়া করে এই যুক্তি দেয়ার আগে চিন্তা তো করুন কী বলছেন! কুরআন মাজিদে বলা হচ্ছে, কাবা শরিফ পৃথিবীর প্রথম নির্মিত ইবাদাতখানা যা শুধুমাত্র মুয়াহহিদদের জন্য নির্মিত। ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম মুসলমানদের জাতির পিতা। তিনি পুনঃনির্মাণ করেন কাবা শরিফ। কাবা শরিফ উনার পরবর্তীতে পৌত্তলিকদের মিসইউজের শিকার ছিল। কাবা শরিফ কোনকালেই মুশরিকদের ছিল না। কাবা শরিফের এই ঘটনার সাথে হাজিয়া সুফিয়া মসজিদের ঘটনার তুলনা অযৌক্তিক। কিয়াস মায়াল ফারিক।
আর মূর্তিপূজারক পৌত্তলিকদের মন্দির ও ইহুদী খ্রীষ্টানদের উপাসনালয় এক কথা নয়। নবি কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং খুলাফায়ে রাশিদিনের জীবনি পড়লেই আমরা তা বুঝতে পারব। ইহুদি খ্রীষ্টানরা আহলে কিতাব। তাদেরকে ইসলামী শরীয়তে কিছুটা হলেও সম্মানের চোখে দেখা হয়েছে পৌত্তলিক মূর্তিপূজারীদের তুলনায়।
মোটকথা আপনি মসজিদ করার পক্ষেই হোন আর যাই হোন, গড়ে মসজিদ করার বিরুদ্ধ বলা মুসলমানদেরকে কাফির-মুরতাদ বললে আপনার ও খারেজিদের মাঝে আর পার্থক্য কী থাকে?
দয়া করে এসব বিষয় নিয়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে মুসলমান মুসলমানে বিভেদ সৃষ্টি বন্ধ করুন। দয়া করে জ্ঞানার্জন, বিজ্ঞান চর্চা এবং আখলাক গঠনে মুসলমান জাতি মনোযোগী হই। এক হাজিয়া সুফিয়া মসজিদ পুরো মুসলিম জাতির ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারবে না। কোনপক্ষেই বাড়াবাড়ি কাম্য নয়।
সর্বোপরি তুরস্কের সর্বোচ্চ আদালতের রায়কে আমরা সম্মান করি।